জাবির আঙিনায় হেমন্ত

জীবনান্দন দাশ হয়তো বাংলার হেমন্তের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েই রচনা করেছিলেন তাঁর অমর কীর্তি ‘রূপসী বাংলা’ কাব্য। সময়ের পরিক্রমায় এই বাংলায় ঋতুর রানী হেমন্ত ফিরে আসে বারেবার। প্রতিবারের মতো এবারও শরতের পিছু পিছু হেমন্ত এসে হাজির রূপের জাদু কাঠি নিয়ে। আর তারই সাজে চিরায়ত সাজে আজ অপরূপ সারা বাংলা, যেন যৌবন ফিরে পেয়েছে।
শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবির মতো আমাদের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। শীত ঘনিয়ে এলে এর রূপ যেন বেড়ে যায় কয়েকগুণ। শীতের ছোঁয়া পেলে চেনা ক্যাম্পাস হঠাৎ করে পাল্টে যায় অচেনা অপরূপে, মনে হয় যেন ভূস্বর্গ। হেমন্ত যেন শীতকে পেছনে করে নিয়ে আসে। হেমন্তের মনোমুগ্ধকর রূপে সাজে পুরো দেশ। বাদ থাকে না আমাদের জাবি ক্যাম্পাসও। ক্যাম্পাসে যে এখন হেমন্ত বিরাজ করছে তা জানার জন্য ক্যালেন্ডারের পাতায় তাকাতে হয় না। ঝড়া পাতার গাছগুলো আর পায়ের নিচের সবুজ ঘাসে জমে থাকা শিশির বিন্দুই জানান দিয়ে যায় হেমন্তের আগমনী বার্তা। কার্তিকের শেষ, অগ্রহায়ণের শুরু। অর্থাৎ হেমন্ত এখন মাঝ বয়সে। এই মাঝ বয়সে জাবি ক্যাম্পাসে হেমন্ত আজ পূর্ণ যৌবনা। ক্যাম্পাসের আশপাশের ধানের ক্ষেতে চোখ রাখলেই বুঝা যায় নবান্নের চিহ্ন। খেজুরগাছে ঝুলছে রসভর্তি কলস। গাছে গাছে আজ পাতা ঝড়ার সুস্পস্ট পূর্বাভাস। সবুজ পাতাগুলো কেন যেন হঠাৎ করেই রুক্ষ হতে শুরু করছে, ঝড়ে ঝড়ে পড়ছে নিচে। রাস্তাঘাটে দেখা যাচ্ছে ঝড়া পাতার ছড়াছড়ি। আবার গতিশীল গাড়ির চলে যাওয়ায় বাতাসের স্রোতে উড়ে যাচ্ছে পাতাগুলো।
হেমন্ত এসেছে যেন শীতের অগ্রদূত হয়ে। সাথে নিয়ে এসেছে একরাশ ঠান্ডা বায়। ঠান্ডা বায়ের শীতল ছোঁয়ায় শরীর কেপে ওঠে বারেবার। ঠান্ডা বায়ের বিরুদ্ধে লড়তে ছাত্রছাত্রীদের গায়ে দেখা যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী শালসহ বাহারি রঙের শীতের পোশাক। চায়ের দোকানগুলোতে জমে উঠছে আড্ডা। গরম চায়ের চুমুকে শরীরকে একটু গরম করে নিচ্ছে তারা। শীত একেবারে জেঁকে না বসলেও কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে। সন্ধ্যা হলেই বাতাসে দেখা যায় কুয়াশার ওড়াউড়ি খেলা। যতই দিন যাচ্ছে বাড়ছে ঠান্ডা, বাড়ছে কুয়াশা। কুয়শার আবরণে ঢাকছে পুরো ক্যাম্পাস।
শীতের সন্ধায় পিঠা খাওয়ার মজাই আলাদা। সূর্যটা পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়তেই ক্যাম্পাসের প্রাণকেন্দ্র বটতলা, রাজনীতি চর্চার কেন্দ্রস্থল ট্রান্সপোর্ট এলাকা, ক্যাম্পাসের বন্ধু চত্বর টারজান, অমর একুশের পাদদেশসহ বিভিন্ন জায়গায় জ্বলে ওঠে পিঠা রান্নার চুলা। পিঠা হতে না হতেই ভিড় পড়ে যায় পিঠার দোকানগুলোতে।
মাঠে হাঁটার সময় পায়ের আঘাতে শিশিরবিন্দু ঝড়ে পড়ে নরম সবুজ ঘাসে। শিশিরের পানিতে ভিজে যায় পা। ভেজা পায়ের ঠান্ডার শিহরণ পুনঃপুন জানান দিয়ে যায় যে শীত আসছে, শীত আসছে। শীত আসছে, তার সাথে উৎসবও আসছে। সেই উৎসবেরই যেন প্রথম অধ্যায় হেমন্ত। ক্যাম্পাসের প্রতিটা ঘাসে, প্রতিটা গাছে বিরাজ করছে হেমন্তের আনন্দ।এই আনন্দ নিতে বাদ থাকছে না ক্যাম্পাসের চতুষ্পদী প্রাণিগুলোও। সকাল হলেই ঘেউ ঘেউ করে জেগে ওঠছে কুকুরগুলো। তারপর একটু হাফ ছেড়ে শরীরটাকে গরম করে নিচ্ছে সকালের সোনা রোদে। গাছে গাছে পাখিগুলোও যেন আজ আনন্দে মুখর। কলকাকলিতে সোনামাখা রৌদ্রোজ্জ্বল সকালকে করে তুলছে আরো মাধুর্যময়। হেমন্তের ছোঁয়ায় ক্যাম্পাসের লেকগুলো হয়ে ওঠেছে শান্ত। তার বুকে চলছে পাখি আর ছোটমাছের গোল্লাছুট খেলা। একটা মাছরাঙা হঠাৎ ফুড়ুৎ করে উড়ে গিয়ে ধড়ে আনছে ছোটমাছ। গাছের ডালে বসে রোদ পোহাচ্ছে আর মজা করে খাচ্ছে। এ যেন প্রকৃতির এক মজার খেলা। ক্যাম্পাসের লেকগুলো আবার ভরে উঠছে লালপদ্মে। কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো ছেয়ে যাবে পুরোটা। এ যেন হেমন্তের উৎসবে ক্যাম্পাস সাজানোর এক অলৌকিক প্রক্রিয়া। প্রকৃতির এই সুন্দর সাজ কার মনকে না টানে। কে চায় না এই নির্মল, শ্যামল, শান্ত, সুন্দর ক্যাম্পাসে একটু মুক্ত আকাশে চেয়ে গাটাকে এলিয়ে দিয়ে হেমন্তের রোদ পোহাতে? কত প্রকৃতিপ্রেমি এখানে এসে মুক্ত আলোয় কুঁড়িয়ে নেয় জীবনের স্বাদ তার ইয়ত্তা নেই। এই নির্মলতা শুধু মানুষকে নয়, কাছে টানে সুদূর সাইবেরিয়ান পাখিদেরও। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি আর বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত সবুজ এই ক্যাম্পাস হেমন্তের আমেজ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বরাবরের মতোই অতিথি পাখির জলকেলিতে মুখর হয়ে উঠতে শুরু করছে জলাশয়গুলো। বাংলার প্রকৃতির বন্ধু হিমালয় হাজার হাজার বছর ধড়ে আমাদের রক্ষা করে চলছে তীব্র ঠান্ডা থেকে। অপরদিকে সাইবেরিয়ান অঞ্চলের প্রচণ্ড ঠান্ডায় এই সময়ে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে পাখিগুলো। তাই বাংলার প্রকৃতি তাদের কাছে টানে। হাজার হাজার মাইলের পথ পাড়ি দিয়ে চলে আসে বাংলাদেশে। তাদের বেশির ভাগই আশ্রয় নেয় তাদের ঐতিহ্যগত ভাবে চেনা আমাদের সুন্দর, নির্মল এই জাবি ক্যাম্পাসে আমাদের অতিথি হয়ে। এমন সুন্দর অতিথি আর কোথায় পাওয়া যায়? রং বেরঙের সুন্দর সুন্দর, হাজার হাজার পাখি বাসা বাঁধে ক্যাম্পাসের পদ্ম সজ্জিত লেকগুলোতে। সুন্দরে সুন্দরে মিলে সৌন্দর্য বেড়ে যায় শত গুণ।পাখিদের নামও বৈচিত্র্যময়। বেশির ভাগ নজরে পড়ে সরালি, খঞ্জনা, পাতারিহাঁস, লালমুড়ি, বামুনিয়া হাঁস, গয়ার, পাতিতারা, মুরহেন, নর্দান, নাকতা, চিতাটুপি, কোম্ব ডাক, ফ্লাই ফেচার, নোনা জোৎস্না, ধূপানি, সিধু ঈগল, হুড হুড, বাড়িঘোরা ইত্যাদি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতিবছর শতাধিক প্রজাতির অতিথি পাখি আসে। এদের বেশির ভাগই হাঁস প্রজাতির। পাখির কিচিরমিচির আওয়াজে ঘুম ভাঙে আমাদের। শীতের সময় অতিথি পাখির সাথে বসবাসের দুর্লভ সুযোগ মনে হয় কেবল জাবি ছাত্রছাত্রীরাই পায়।পাখি যে প্রকৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ, জাবি ক্যাম্পাস তার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ। এত দূর থেকে যারা অতিথি হয়ে এসেছেন, তাদের কী আর অনাদরে রাখলে হয়? এদের জন্য রয়েছে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা যাতে নির্ভিগ্নে সোনামাখা রোদে পাখা ঝেপ্টে করতে পারে খুনসুটি, গাইতে পারে কলকাকলি গান। প্রশাসনের পক্ষ থেকে কয়েকটা লেককে ঘোষণা করা হয়েছে তাদের একক অতিথিশালা, অর্থাৎ অভয়ারণ্য। গঠন করা হয়েছে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কমিটি। অতিথিরা এখানে অতিথির মতোই সমাদৃত।
এই হেমন্তে অন্যান্য ক্যাম্পাস যখন নগরজীবনের যান্ত্রিকতায় পিষ্ট, সেখানে আমাদের জাবি ক্যাম্পাস হয়ে উঠেছে প্রকৃতির এক নৈস্বর্গ। অতিথি পাখির কলতানে বাতাস হয়ে উঠেছে সুমধুর। সকালের সোনারোদে পাখির পাখা ঝাপটে উড়ে চলা, খুনসুটি মনের মধ্যে বয়ে আনছে রোমান্স, কোমলতা আর জাগায় বেঁচে থাকার স্বাদ। ক্যাম্পাসের কুয়াশায় গা জড়াতে, ঠান্ডা বাতাসে গা টাকে শিহরিত করতে, পদ্মফুলের মাঝে পাখির একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকা দেখতে আর শিতের পিঠা চিবোতে এই নৈস্বর্গে প্রতিবছর পা ফেলে দেশ-বিদেশের হাজারো পর্যটক। তারা আসে, দেখে, জুড়িয়ে নেয় প্রাণ আর মনকে আকুল করে তোলে পরের বছরের অপেক্ষায়। আপনাকেও স্বাগত আমাদের এই অতিথি পাখির ক্যাম্পাসে, এই হেমন্তে।