বিএসসি ও ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের ‘দ্বন্দ্ব’ মিটবে কবে?

‘প্রকৌশলী’শব্দটি কারা ব্যবহার করতে পারবেন? বিএসসি, নাকি ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারীরা? সরকারি চাকরির দশম গ্রেডের উপ-সহকারি প্রকৌশলী পদটি শুধুমাত্র ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারীদের জন্য কেন নির্ধারিত? বিএসসি করার পরও কেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এখানে পরীক্ষা দিতে পারবেন না? এ নিয়েই পরস্পরবিরোধী অবস্থানে পলিটেকনিক ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গত তিন মাস ধরে পৃথকভাবে আন্দোলন করছে দুই পক্ষই। এতে ভোগান্তি পোহাচ্ছেন সাধারণ রাজধানীবাসী।
সর্বশেষ গত বুধবার সাতরাস্তা অবরোধ করে মিছিল, সমাবেশ করেছে পলিটেকনিকের শিক্ষার্থীরা। প্রায় তিন ঘণ্টা সড়কটি বন্ধ থাকায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন রাস্তায় বের হওয়া সাধারণ মানুষ। অন্যদিকে শুক্রবার ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশনে আলোচনা সভা করেছেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দুই পক্ষই সোমবার থেকে আবার আন্দোলন করতে রাজপথে নামার ঘোষণা দিয়েছে।
পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের দাবি
১. প্রকৌশল অধিকার আন্দোলন কর্তৃক ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের প্রকাশ্যে গুলি করা ও গলাকেটে হত্যার হুমকি প্রদানকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
২. বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার্থীদের অযৌক্তিক তিন দফা দাবির পক্ষে পরিচালিত সব কার্যক্রম রাষ্ট্র কর্তৃক অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
৩. কারিগরি ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের উত্থাপিত যৌক্তিক ছয় দফা দাবির রূপরেখা ও সুপারিশ অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে হবে।
৪. ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ান-চ্যানেল এডুকেশন চালু করতে হবে।
প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দাবি
১. সরকারি চাকরির দশম গ্রেড সব প্রকৌশলীর জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে।
২. ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারীরা প্রকৌশলী শব্দ ব্যবহার করতে পারবেন না। তাদের টেকনিশিয়ান বলতে হবে।
৩. ২০১৩ সালে রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে।
৪. কোনো ধরনের কোটা নয়, মেধার ভিত্তিতেই চাকরির নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে।
গত এপ্রিলে আন্দোলন চলাকালে প্রকৌশল শিক্ষার্থীরা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের দিকে যেতে চাইলে টিয়ার শেল, জলকামান ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের বাধা দেয় পুলিশ। শিক্ষার্থী-পুলিশ মুখোমুখি অবস্থানে আহত হন বেশ কয়েকজন। একই তিন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারীরাও এদিন পাল্টা দাবিতে কর্মসূচি পালন করেছেন। তারাও গাজীপুরসহ দেশের কয়েকটি স্থানে সড়ক অবরোধ করে ক্ষোভ জানিয়েছেন।
প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে কেন?
চাকরির বাজারে প্রবেশ এবং পদোন্নতির ক্ষেত্রে বৈষম্যের অভিযোগ এনেছে দুপক্ষই। এছাড়া পেশাগত মর্যাদা ও যোগ্যতার ক্ষেত্রে ‘কে কার থেকে বড়’এই প্রসঙ্গও তুলে এনেছেন আন্দোলনকারীরা। বৈষম্য রয়েছে বলে দাবি করেছেন শিক্ষক ও পেশাজীবীরাও।
রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. রবিউল ইসলাম সরকার ডয়চে ভেলেকে বলেন, “বিএসসি ইঞ্জিনিয়াররা যদি যোগ্য হয় তাহলে কেন তাদেরকে দশম গ্রেডে পরীক্ষার সুযোগ দেওয়া হবে না? একজন যদি নবম গ্রেডে চাকরির পরীক্ষা দিতে পারে, ১৩তম গ্রেডের পরীক্ষা দিতে পারে, তাহলে দশম গ্রেডে কেনো পারবে না? এই পদটা তো উপ-সহকারি প্রকৌশলী পদ। কেন তাদের জন্য এই পদ ব্লক করে রাখা হবে। সারা বিশ্বে কোথায় ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারীদের প্রকৌশলী বলা হয় না। তাদের টেকনিশিয়ান বলা হয়। যে কারণে বাংলাদেশের ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারী বিদেশে যেতে পারে না। কারণ তাদের প্রকৌশলী হিসেবে গ্রহণ করে না। অথচ তাদের নামের পাশে টেকনিশিয়ান থাকলে তারা বিদেশেও যেতে পারত। আবার দশম গ্রেডে তারা ঢুকে ৫ বছরের অভিজ্ঞতা দিয়ে নবম গ্রেডে চলে যাচ্ছে। ফলে নবম গ্রেডে প্রকৌশলী পদে নিয়োগ হচ্ছে না। ফলে দেশের সর্বত্র ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারী দিয়ে ভরে যাচ্ছে। অথচ বিএসসি করা শিক্ষার্থীরা চাকরি পাচ্ছে না। এটা একটা দেশের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।”
প্রকৌশলী পেশায় বিএসসি ডিগ্রি এবং ডিপ্লোমাধারীদের বিদ্যমান জটিলতা বেশ পুরোনো। এই সমস্যা নিরসনে অতীতের অনেক সরকার নানা পদক্ষেপ নিলেও সমাধান মেলেনি। উল্টো প্রতিবারই এ নিয়ে পাল্টাপাল্টি আন্দোলনে নেমেছে দুই পক্ষ। মূলত এইচএসসি সম্পন্ন করে বুয়েট, চুয়েট, রুয়েট ও কুয়েটের মতো প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরা বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। আর এসএসসি বা এইচএসসি পাশ করার পর, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে বিভিন্ন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে প্রকৌশল বিষয়ে চার বছর বা তিন বছর ছয় মাস মেয়াদি ডিপ্লোমা-ইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স সম্পন্ন করেন ডিপ্লোমাধারীরা।
জটিলতার শুরুটা হয় চাকরির বাজারে গিয়ে। প্রকৌশল পেশায় সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে দশম গ্রেডের উপ-সহকারি প্রকৌশলী পদে কেবল ডিপ্লোমাধারী শিক্ষার্থীরাই আবেদন করতে পারেন। এরপর চাকরির অভিজ্ঞতা বা যোগ্যতার ভিত্তিতে নবম গ্রেডে পদোন্নতি হয়। এক্ষেত্রে ৩৩ শতাংশ কোটা বা সুবিধাও পান তারা। ডিপ্লোমাধারী শিক্ষার্থীরা বিএসসি সম্পন্ন করে বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমেও নবম গ্রেডের চাকরিতে যোগ দেওয়ার সুযোগ পান। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি শেষ করে বিসিএসের মাধ্যমে নবম গ্রেডে অথবা ১১-১৬তম গ্রেডে চাকরির সুযোগ পেলেও দশম গ্রেডে আবেদনের কোনো সুযোগ পান না বিএসসি ডিগ্রিধারীরা।
এই প্রক্রিয়াকে বৈষম্যমূলক বলে মনে করেন প্রকৌশল অধিকার আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক সাকিবুল হক লিপু। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, দশম গ্রেডের নিয়োগ পরীক্ষায় শুধু ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়ায় বৈষম্যের শিকার তারা। এছাড়া নবম গ্রেডে ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের ৩৩ শতাংশ কোটাভিত্তিক পদোন্নতির সুযোগ চাকরির বাজরের ভারসাম্য নষ্ট করেছে। গত বছর যেখানে কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে শিক্ষার্থীরা জীবন দিয়েছেন সেখানে কেন এখনও কোটা বহাল থাকবে। এটা হতে পারে না। আবার ডিপ্লোমাধারীদের নামের সঙ্গে প্রকৌশলী পদবী ব্যবহার করা তো কোনভাবেই যৌক্তিক না।”
প্রসঙ্গত, প্রতি বছর প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রায় ২০ হাজারের মতো শিক্ষার্থী বিএসসি ডিগ্রী নিয়ে চাকরির বাজারে আসছেন। এখনও এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ২ লাখের মতো শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন।
পলিটেকনিক শিক্ষার্থীরা যে কারণে আন্দোলনে
কারিগরি ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের সভাপতি মাশফিক ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, “দেশের বিপুল সংখ্যক ডিপ্লোমাধারীর চাকরির অনিশ্চয়তা দূর করতেই দশম গ্রেড তাদের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। ১৯৭৮ সালে একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ‘উপ-সহকারী প্রকৌশলী’পদ সৃষ্টি করে সরকার। এছাড়া সহকারি প্রকৌশলী পদে ৩৩ শতাংশ পদোন্নতির বিষয়টিও নির্ধারণ করা হয়। পদোন্নতি ও প্রকৌশলী পদবী ব্যবহারের বিষয়ে আইন ও বিধি নির্ধারণ হয়েছে ১৯৯৩ সালে। প্রতি বছর দুই লাখের বেশি শিক্ষার্থী ডিপ্লোমা ডিগ্রি নিয়ে চাকরির বাজারে আসছে। এখনো পড়াশোনা করছে ৩০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী।”
পদোন্নতির ব্যাপারে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস নিয়োগ বিধিমালা-১৯৮১ এবং প্রকৌশলী পদবী ব্যবহারের ক্ষেত্রে ২০২০ সালের বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) এর গেজেটের কথা উল্লেখ করে মাশফিক বলেন, “প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে উত্তীর্ণদের প্রকৌশলী ও স্থপতি হিসেবে এবং কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে থাকা বিভিন্ন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে উত্তীর্ণদের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার ও ডিপ্লোমা আর্কিটেক্ট হিসেবে সজ্ঞায়িত করা হয়েছে।”
হঠাৎ করেই কেন বিষয়টি সামনে এল? জানতে চাইলে ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশের আহ্বায়ক প্রকৌশলী কবীর হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, “যেটা নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে, সেটা তো সেটেল্ড ইস্যু। কিন্তু এখন সামনে এসেছে চাকরি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক দেড় লাখ টাকা নিয়ে সার্টিফিকেট দিয়ে দিচ্ছে। তারা কোথাও চাকরি পাচ্ছে না। তাদের তো নবম গ্রেডে ঢোকার কথা। কিন্তু তারা দশম গ্রেডে ঢোকার জন্য পাগল হয়ে গেছে। আগে বুয়েটসহ কয়েকটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অল্প সংখ্যক যোগ্য শিক্ষার্থী বের হতো। তাদের চাকরির সমস্যা হতো না। এখন তারা ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারীদের পদে ঢুকতে চাইছে। মানুষ উপরে যেতে চায় আর তারা নিচে নামার জন্য আন্দোলন করছেন।”
মাশফিক ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘প্রকৌশলী অধিকার আন্দোলন’ এর ব্যানারে অযৌক্তিত ও নীতি বিরুদ্ধ দাবি তুলেছেন বিএসসি ডিগ্রিধারী প্রকৌশলীরা। কোনভাবেই আমাদের জন্য নির্ধারিত দশম গ্রেডের কর্মক্ষেত্র বাতিল করতে দেওয়া হবে না। এই মুহর্তে বিএসসি ডিগ্রিধারী দেশে সর্বোচ্চ ২ থেকে ৩ লাখ কিন্তু ডিপ্লোমাধারী ২০ লাখেরও বেশি। এতগুলো মানুষ তাহলে কোথায় যাবে?
কারিগরি ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের প্রধান কার্যকারী উপদেষ্টা রহমত উল আলম সিহাব ডয়চে ভেলেকে বলেন, “একটা দেশে যখন বেকারের সংখ্যা বেশি হয়ে যায় তখন সাধারণ শিক্ষা বন্ধ রেখে কারিগরি শিক্ষার দিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। যাতে তারা বাস্তব জ্ঞান অর্জন করে কিছু করতে পারেন। বাংলাদেশে এখন বেকারের সংখ্যা এত বেশি যে, সাধারণ শিক্ষা নয়, কারিগরি শিক্ষার দিকে গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ এবং তাদের কাজের জায়গা বাড়ানো উচিৎ। সেটা না করে উল্টো কারিগরি শিক্ষার্থীদের পেশাগত জায়গা সংকুচিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।”