১৪০০ শহীদের পিতা-মাতা বেঁচে আছেন বিচারের আশায়

গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হামলা, গণহত্যাসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে করা মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দ্বিতীয় দিনের মতো সাক্ষ্য দিয়েছেন আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক, লেখক ও গবেষক ড. মাহমুদুর রহমান। এদিন তিনি আদালতে জুলাই আন্দোলন দমনে হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জিয়াউল আহসানসহ কয়েকজন সাবেক সেনা কর্মকর্তার ভূমিকা বর্ণনা করেন।
সাক্ষী ড. মাহমুদুর রহমান বলেন, ১৪০০ শহীদের পিতা-মাতা বেঁচে আছেন বিচারের আশায়। আদালতে শহীদদের পিতা-মাতার বিচার পাওয়ার আকুতি তুলে ধরেন তিনি।
আজ মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে মাহমুদুর রহমান উপস্থিত হন। আজ বেলা ১১টা ৩০ মিনিট থেকে তিনি অবশিষ্ট সাক্ষ্য প্রদান শুরু করেন। সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে দুপুরের পর মাহমুদুর রহমানকে জেরা করেন শেখ হাসিনার রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী অ্যাডভোকেট আমির হোসেন। এই মামলায় এখন পর্যন্ত মোট ৪৬ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়েছে।
আজ এ মামলায় সাক্ষ্য দিতে ট্রাইব্যুনালে গিয়েছিলেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। তবে আজ মাহমুদুর রহমানের সাক্ষ্য গ্রহণ ও জেরা থাকায় তিনি আগামীকাল সাক্ষ্য প্রদান করবেন।
জিয়াউল আহসান সবচেয়ে বিতর্কিত এক জুলুমকারী
দ্বিতীয় দিনের অবশিষ্ট জবানবন্দিতে সাক্ষী আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘মোল্লা ফজলে আকবর, লে. জেনারেল মামুন খালেদ, লে. জেনারেল মো. আকবর হোসেন, জেনারেল সাঈফুল আমিন, তাবরেজ শামস ও হামিদুল হক গুম এবং অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। র্যাবের সেনা সদস্যদের মধ্যে মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান সবচেয়ে বিতর্কিত এক জুলুমকারীর ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশের বাইরে থেকে ভারত শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি ছিল। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত সবসময় তার আধিপত্য কায়েম করতে চেয়েছে। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসিয়ে ভারত বাংলাদেশকে প্রকৃতপক্ষে একটি অঘোষিত উপনিবেশে পরিণত করেছিল।’
তিনটি নির্বাচনে ভারত সরাসরি হস্তেক্ষেপ করেছিল
সাক্ষী মাহমুদুর রহমান বলেন, “২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ভারতের তদানিন্তন পররাষ্ট্র সচিব ঢাকায় এসে জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে অংশ গ্রহণে বাধ্য করেছিলেন। এর মধ্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছে। ২০১৮ ও ২০২৪ এর ভুয়া নির্বাচনের পরেও ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আমেরিকা এবং ইউরোপে শেখ হাসিনার পক্ষে লবিং করেছে। জুলাই বিপ্লবে আমাদের তরুণেরা তাদের জীবন দিয়ে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধার করেছে। এ প্রসঙ্গে আমি বুয়েটের শহীদ আবরার ফাহাদের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে চাই। কেবল ভারতের অধিপত্ববাদের বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দেওয়ার জন্যে সারা রাত ধরে তার ওপর নির্মম অত্যাচার করে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা তাকে হত্যা করেছিল। আমি বিগত ১৫ বছর ধরে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের চিত্র আমার লেখায় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি। এ পর্যন্ত আমার প্রায় ১৫টি বই প্রকাশিত হয়েছে, যার মধ্যে দুটি ইংরেজি ভাষায়। প্রাসঙ্গিক বইয়ের মধ্যে ‘হাসিনার ফ্যাসিবাদ নির্বাসন থেকে দেখা’, ‘গুমের জননী’, ‘দ্য পলিটিকেল হিস্ট্রি অব মুসলিম বেঙ্গল’ ও ‘দ্য ইন্ডিয়ান হেজিমনি ইন সাউথ এশিয়া’ অন্যতম।”
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে জুলাই অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার মানবতাবিরোধী অপরাধের বর্ণনা
সাক্ষী মাহমুদুর রহমান আদালতে বলেন, ‘শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকার মহান জুলাই বিপ্লবের সময় যে গণহত্যা চালিয়েছে এবং যে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, সে সম্পর্কে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন একটি তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেই তদন্ত প্রতিবেদনে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ আছে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গণহত্যা চালানের জন্যে সরাসরি নির্দেশ দিয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল প্রতি রাতে তার বাড়িতে কোর কমিটির সভা করতেন। সেখানে পুলিশ এবং অনান্য গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা অংশগ্রহণ করতেন। সেই সভায় তারা বিক্ষোভকারী এবং আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছাত্রদের ওপরে সর্বাত্মক শক্তি প্রয়োগের উপায় নিয়ে আলোচনা করতেন। সেসব সভায় তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বরাতে জানিয়েছেন, আন্দোলনকারীদের ওপর যেন মারণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়।’
মাহমুদুর রহমান আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রকাশ্যে মিডিয়াতে ঘোষণা করেছিলেন, আন্দোলনকারীদের দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের হত্যা করে লাশ গুম করার নির্দেশ দিয়েছেন। জাতিসংঘের রিপোর্টে প্রমাণিত হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট সিনিয়র কর্মকর্তাদের সরাসরি নির্দেশে গণহত্যা চালানো হয়েছে। তাদের প্রত্যেকের ওপর কমান্ড রেসপনসিবিলিটির দায় পড়ে।’
‘জাতিসংঘের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, জুলাই বিপ্লবে প্রায় এক হাজার ৪০০ আন্দোলনকারীকে হত্যা করা হয়েছে। এই রিপোর্টটিতে প্রধানত জুলাই বিপ্লবে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু ১৫ বছর ধরে যে ফ্যাসিস্ট শাসন ব্যবস্থা বাংলাদেশের জনগণের ওপর যে অবর্ণনীয় জলুম জালিয়েছে, সে সম্পর্কে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিয়মিত আলোচনা এবং সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট প্রতি বছর যে হিউম্যান রাইটস রিপোর্ট প্রকাশ করে থাকে, সেগুলোতেও শেখ হাসিনার শাসন আমলে বংলাদেশে গণতন্ত্রহীনতা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের বর্ণনা রয়েছে। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে যে তিনটি ভুয়া নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সে সম্পর্কেও মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের হিউম্যান রাইটস রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সংসদেও উক্ত তিনটি নির্বাচনকে ত্রুটিপূর্ণ বলে প্রস্তাব পাস করা হয়েছে।’
‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস ম্যান’ প্রতিবেদনে সাবেক সেনাপ্রধানের অপরাধের বর্ণনা
মাহমুদুর রহমান সাক্ষীর জবানবন্দিতে বলেন, “আন্তর্জাতিক মিডিয়ার মধ্যে আল জাজিরা ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস ম্যান’ শিরোনামে যে প্রতিবেদন সারাবিশ্বে সাড়া ফেলেছিল, সেখানে শেখ হাসিনা, তৎকালীন সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা ও সামরিক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকীর দুর্নীতি এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের বর্ণনা রয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পেরেছি, কোনো ফ্যাসিস্ট রেজিম কিংবা অটোক্রেটিক গণতান্ত্রিক উপায়ে অপসারিত করা সম্ভব হয় নাই। আমরা মধ্যপ্রাচ্যে আরব রেভ্যুলুশনের সময় মিসর এবং তিউনিশিয়ায় গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারী সরকারের পতন দেখেছি। বাংলাদেশেও ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতন হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ইতালি ও জার্মানিতে ফ্যাসিস্ট শাসক মুসোলিনি ও হিটলারের পতন হয়েছিল যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর। জার্মানিতে সেই সময় জনগণ, বিশেষ করে ‘ইহুদি জনগোষ্ঠীর ওপরে যে গণহত্যা চালানো হয়েছিল, সেই প্রেক্ষাপটে সারা বিশ্বে আওয়াজ উঠেছিল ‘নেভার এগেইন’, অর্থাৎ আর যেন কখনো হিটলারের মতো নিষ্ঠুর ফ্যাসিস্ট শাসকের আগমন না ঘটে। বাংলাদেশেও শেখ হাসিনার ১৫ বছরের চরম দুর্নীতিপরায়ন এবং মানবতাবিরোধী শাসনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশা হলো আর যেন কখনো আমাদের দেশে এমন ফ্যাসিবাদী শাসনের প্রত্যাবর্তন না ঘটে।’
১৪০০ শহীদের পিতা-মাতা বেঁচে আছেন বিচারের আশায়
ড. মাহমুদুর রহমান ট্রাইব্যুনালকে বলেন, ‘কয়েকদিন আগে জুলাই শহীদ ফাইয়াজের পিতা আমাকে ফোন করেছিলেন। একদিন পরে তার ছেলের ১৮ বছর হওয়ার কথা ছিল। ফাইয়াজ ২০২৪ সালের ১৭ জুলাই রিকশা করে বাড়িতে ফিরছিল। সেই রিকশার মধ্যেই ফ্যাসিবাদী সরকারের পুলিশ সেই কিশোরকে গুলি করে হত্যা করেছিল। শহীদ ফাইয়াজের পিতা আমাকে অনুরোধ করেছিলেন, তার শহীদ ছেলের জন্মদিনে আমি যেন আমার দেশ পত্রিকায় একটা সংবাদ ছাপাই। আমি সেই পিতার অনুরোধ রক্ষা করেছি। শহীদ ফাইয়াজের পিতার মতো এমন অন্তত এক হাজার ৪০০ শহীদের পিতা ও মাতা সন্তানের শোক নিয়ে বেঁচে আছেন। এই শহীদ পরিবারগুলো ন্যায়বিচার দেখার অপেক্ষায় রয়েছে। এর সঙ্গে আরও যে অন্তত ২০ হাজার আহত জুলাই যোদ্ধা চরম কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন, তারাও ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা এবং তার সরকারের কমান্ড রেসপনসিবিলিটিতে যারা ছিলেন তাদের বিচার দেখতে চান। এই আসামিদের মধ্যে যারা সরাসরি হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন এবং যারা উক্ত হত্যাকাণ্ড ও নৃশংসতা বন্ধ করার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি, তারা সবাই কমান্ড রেসপনসিবিলিটির আওতাভুক্ত।’
মাহমুদুর রহমান সাক্ষীর জবানবন্দিতে বলেন, “আমি বিগত ১৬ বছর ধরে এই ফ্যাসিবাদের উত্থান, বিকাশ ও পতন প্রত্যক্ষ করেছি। এই বিষয়ে অনবরত লেখালেখি করেছি এবং বিভিন্ন সভা, সেমিনার ও মিডিয়ায় বক্তব্য দিয়ে জনগণকে অবহিত করার চেষ্টা করেছি। জুলাই গণহত্যার পর যখন এই ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠিত হয়েছে, আমি মনে করেছি—রাষ্ট্রের একজন বর্ষিয়ান নাগরিক হিসেবে আমার কর্তব্য ট্রাইব্যুনালকে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সর্বাত্মক সহযোগিতা করা। সেই সহযোগিতার অংশ হিসেবে আমি ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য প্রদান করছি। আমি চাই অপরাধীরা যেন সাজা পায়, শহীদ পরিবার, আহত জুলাই যোদ্ধা এবং তাদের পরিবার ন্যায়বিচারের মাধ্যমে তাদের শোক কিছুটা হলেও লাঘব হয়। এ ছাড়া ফ্যাসিস্ট শাসনের বিষয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা গেলে ভবিষ্যতের সরকাগুলোহ সতর্ক হবে বলে আমি প্রত্যাশা করি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যেভাবে বলা হয়েছিল ‘নেভার এগেইন’, বাংলাদেশেও এই বিচারের মাধ্যমে নিশ্চিত হোক যেন গত ১৫ বছরের দুঃশাসনের পুনরাবৃত্তি আর না হয়।”
গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ আমলে নিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এই পাঁচটি অভিযোগে তাদের বিচার করা হচ্ছে। অপর দুই আসামি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।
গত ১ জুন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এই আসামিদের বিরুদ্ধে পাঁচ অভিযোগ আমলে নেন। আমলে নেওয়া পাঁচ অভিযোগ হলো—
প্রথম অভিযোগ
শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আমলে নেওয়া অভিযোগের প্রথমটিতে বলা হয়, শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই চীন থেকে ফিরে গণভবনে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। এ সময় আন্দোলনরত ছাত্রদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে অভিহিত করে ছাত্র- জনতার ওপর নির্যাতনের উসকানি দেওয়া হয়। আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন তার অধীনস্থ বাহিনীকে হামলার জন্য সুপিরিয়র কমান্ডার হিসেবে নির্দেশ দেন। এতে করে রাজধানীর মিরপুর, আশুলিয়া, যাত্রাবাড়ি গাজীপুরসহ সারা দেশে নিহতদের জানাজা ও সৎকার করা, হাসপাতালে লাশ হস্তান্তরে বাধা প্রদান করা হয়। এসব কর্মকাণ্ড করে আসামিরা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন।
দ্বিতীয় অভিযোগ
জুলাই- আগস্ট আন্দোলনের সময় সুপিরিয়র কমান্ডার শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য (ভিসি) এস এম মাকসুদ কামাল ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। এসব ফোনকলে আন্দোলন ঠেকাতে ছাত্র-জনতার ওপর মারণাস্ত্রের ব্যবহার করার কথা বলা হয়। নির্দেশ পেয়ে হেলিকপ্টার থেকে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করা হয়। এসব ফোনের অডিও ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা হয়েছে। নির্দেশদাতা হিসেবে শেখ হাসিনা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন। এ ছাড়া সাবেক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বাহিনীকে মারণাস্ত্র ব্যবহারের জন্য নির্দেশনা দিয়ে প্রায় দেড় ছাত্র-জনতাকে হত্যা এবং ২৫ হাজার মানুষকে আহত করে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন।
তৃতীয় অভিযোগ
১৬ জুলাই রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে তার ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন চারবার পরিবর্তন করা হয়। এ ঘটনায় নিহত আবু সাঈদের সহপাঠীদের আসামি করে মামলা করে পুলিশ। সুপিরিয়র কমান্ডার হিসেবে শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের নির্দেশে এই হত্যা, তথ্য গোপন ও মিথ্যা মামলা করা হয়। এসবের নির্দেশ দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন তিন আসামি।
চতুর্থ অভিযোগ
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা এক দফা বাস্তবায়নের দাবিতে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে আসার সময় চাঁনখারপুল এলাকায় শহীদ আনাসসহ ছয়জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সুপিরিয়র কমান্ডার হিসেবে এ ছয়জনকে হত্যা করে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।
পঞ্চম অভিযোগ
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা এক দফা বাস্তবায়নের দাবিতে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে আসার সময় আশুলিয়ায় ছাত্রদের গুলি করে হত্যা করে লাশ পুড়িয়ে ভস্মীভূত করা হয়। এ ঘটনার নির্দেশদাতা হিসেবে শেখ হাসিনাসহ তিন আসামি মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন। এই আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তির আবেদন করে প্রসিকিউশন।