দূরে কোথাও
ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষী বলিহার রাজবাড়ি

রাজা নেই, রাজ্য নেই। সময়ের ঘূর্ণিপাকে সেই রাজকীয় জৌলুস এখন কেবলই স্মৃতি। তবুও কালের সাক্ষী হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে নওগাঁর বলিহার রাজবাড়ি। তবে দেবদাসীদের নূপুরের নিক্বণ, শঙ্খধ্বনি আর খোল-করতালের সম্মিলিত সুর বহু আগেই স্তব্ধ হয়ে গেছে। ভগ্ন এই রাজপ্রাসাদের প্রতিটি ইটে, প্রতিটি বাতাসে যেন মিশে আছে এক হারানো দিনের গল্প। এই ভগ্নপ্রায় প্রাসাদের প্রতিটি কোণে হয়তো এখনো ভেসে বেড়ায় রাজকীয় হাসি আর কান্নার প্রতিধ্বনি।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সনদ বলে নৃসিংহ চক্রবর্তী নওগাঁর বলিহারের জায়গীর লাভ করেন। জমিদারদের মধ্যে জমিদার রাজেন্দ্রনাথ ১৮২৩ সালে এখানে একটি রাজ-রাজেশ্বরী দেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। বলিহারের ৯ চাকার রথ এক সময় এতদঞ্চলে প্রসিদ্ধ ছিল। প্রাসাদের কিছুটা দূরে ছিল বিশাল বাগান, যেখানে এখনো কিছু রাজার আমলের গাছ টিকে আছে।
জনশ্রুতি আছে, মোগল সম্রাট আকবরের সেনাপতি রাজা মানসিংহ বারো ভূঁইয়াদের দমন করতে এদেশে এসে বলিহারে যাত্রাবিরতি করেন। সৈন্যরা অলস হয়ে যেতে পারে ভেবে তিনি ৩৩০টি দীঘি ও পুকুর খনন করান, যা এখনো বলিহারজুড়ে ছড়িয়ে আছে।
বলিহার রাজবাড়িতে নিয়মিত জলসার আসর বসতো, যেখানে কলকাতা থেকে বিখ্যাত নাচিয়ে-গাইয়ে আনা হতো। এই রাজপরিবারের অনেকেই ছিলেন উচ্চ শিক্ষিত। রাজা কৃষ্ণেন্দ্র নাথ রায় বাহাদুর একজন লেখক ছিলেন। তার লেখা গ্রন্থগুলোর মধ্যে ‘কৃষ্ণেন্দ্র গ্রন্থাবলি’ অন্যতম। সৌখিন জমিদারদের একটি মিনি চিড়িয়াখানা ছিল, যেখানে বাঘ, ভালুক, বানর, হরিণসহ বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখি ছিল।
রাজবাড়ির সামনে ছিল একটি প্রশস্ত সড়ক, যা রাজশাহীর সঙ্গে নওগাঁর একমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল ১৯৮০ সাল পর্যন্ত।
দেশ বিভাগের সময় ও জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে অন্যান্যদের মতো বলিহারের শেষ রাজা বিমেলেন্দু রায় চলে যান ভারতে। এরপর রাজবাড়ির মূল্যবান আসবাবপত্র, জানালা-দরজাসহ বিভিন্ন সামগ্রী লুট হয়ে যায়। বর্তমানে দর্শনীয় কয়েকটি ভবন কোনো রকমে দাঁড়িয়ে এক সময়ের বলিহার রাজাদের ঐতিহ্যের জানান দিচ্ছে। প্রাসাদের বিশাল দেবালয়টি এখনো স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায় পূজা-অর্চনার জন্য ব্যবহার করে।

নওগাঁর ইতিহাসপ্রেমীদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা অবশেষে পূরণ হয়েছে। সম্প্রতি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বলিহার রাজবাড়িকে ‘সংরক্ষিত পুরাকীর্তি’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত সাইনবোর্ডও লাগানো হয়েছে। গত ২৪ মার্চ ২০২২ তারিখে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় এই প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করে ও ২৫ আগস্ট ২০২২ সালে বাংলাদেশ গেজেট কর্তৃপক্ষ তা প্রকাশ করে।
নওগাঁর পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের কাস্টোডিয়ান ফজলুল করিম জানান, গেজেট হাতে পাওয়ার পর প্রাচীন স্থাপনাটি সংরক্ষণের আওতায় আনা হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ স্থাপনাটি সংরক্ষণ ও সংস্কার করে পূর্বের আদলে ফিরিয়ে আনতে একটি প্রকল্পের উদ্যোগ নিয়েছেন। এর মাধ্যমে বলিহার রাজবাড়িকে পর্যটকদের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে।
যেভাবে যাবেন বলিহার রাজবাড়ি
ঢাকা থেকে বাসে করে নওগাঁর বলিহার রাজবাড়ি যাওয়া বেশ সহজ। ঢাকার কল্যাণপুর, গাবতলী বা আব্দুল্লাহপুর বাসে করে সরাসরি নওগাঁ যেতে পারবেন। বাসভেদে এসি/নন-এসি ভাড়া পড়বে আনুমানিক ৬৮০ থেকে এক হাজার ৪০০ টাকা।
নওগাঁ পৌঁছে বালুডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড থেকে নওগাঁ-মহাদেবপুর সড়ক হয়ে রাজশাহীগামী বাসে করে বলিহারে যেতে পারবেন। বলিহার কলেজের উত্তরেই এই রাজবাড়িটি অবস্থিত।

কোথায় থাকবেন
নওগাঁ শহরের আশপাশে বেশ কিছু আবাসিক হোটেল রয়েছে।
কোথায় খাবেন
বালুডাঙ্গা বাস স্টেশনে সাধারণ মানের খাবারের দোকান রয়েছে। এছাড়া ভালো মানের রেস্তোরাঁর জন্য নওগাঁর গোস্তহাটির মোড়ে যেতে পারেন।