প্রতিকূল আবহাওয়ার নেতিবাচক প্রভাবে বিপর্যস্ত জনজীবন

মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত ১৩ বার সমুদ্রবন্দরকে সতর্ক সংকেত দেখাতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। টানা নিম্নচাপ ও সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর কারণে সৃষ্ট বৈরী আবহাওয়ার কারণে প্রায়ই সমুদ্রবন্দরগুলোতে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়ে থাকে।
আবহাওয়ার এই অবনতির কারণে একদিকে যেমন বাংলাদেশের দুর্যোগঝুঁকিতে থাকার বিষয়টি সামনে এসেছে, তেমনি সারা দেশেই এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
বিরুপ আবহাওয়ার কারণে উপকূলে বারবার আছড়ে পড়ছে জোয়ারের প্রচণ্ড ঢেউ, নদ-নদীর পানি ফুলে উঠে অতিক্রম করেছে বিপৎসীমা। আবার কখনো কখনো ভারী বৃষ্টিপাতে জনজীবনে নেমে আসে চরম দুর্ভোগ। বিরূপ আবহাওয়ার এসব প্রত্যক্ষ প্রভাবে আচমকাই জনমানুষের জীবনযাত্রা ও ব্যবসা-বাণিজ্যে বিঘ্ন ঘটছে।
এ তো গেল প্রত্যক্ষ প্রভাবের কথা, জোয়ারের পানি কিংবা ভারী বৃষ্টিপাতে কৃষকের ফসল যখন তলিয়ে যায়, তখন নগরবাসীকে সবজি কিনতে গুনতে হয় বাড়তি টাকা। আকস্মিক বন্যায় এ বছরও বহু মানুষের ঘরবাড়ি তলিয়েছে, ভেসে গেছে চাষের মাছ, গবাদি পশুসহ আরও অনেক কিছু।
আবার লঘুচাপ সৃষ্টির কারণে মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে প্রায়ই উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়ে থাকে। লঘুচাপ থাকাকালে জেলেদের গভীর সমুদ্রে যেতে নিষেধ করা হয়।
এসবের পরোক্ষ প্রভাবে সারা দেশের বাজারগুলোতে বাড়ে মূল্যস্ফীতি। বিশেষত ইলিশ ও সবজির দাম চলে যায় নাগালের বাইরে। আর এসব প্রভাবই বর্তমানে দেশের কাঁচাবাজারগুলোতে বিরাজমান। কাঁচা খাদ্যদ্রব্য কিনতে মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে।
পটুয়াখালীর মহিপুরের মাছ ব্যবসায়ী আল আমিন বলেন, খারাপ আবহাওয়ার কারণে এবার ইলিশ উৎপাদন অনেক কমেছে। সাগর এতবার উত্তাল থাকায় মাছ ধরতে যাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি বঙ্গোপসাগরে পাঠানো তার তিনটি ট্রলার দুই দিনের মধ্যেই ফিরে এসেছে। প্রতিটি ট্রলারে গড়ে মাত্র ৫ লাখ টাকার মতো ইলিশ ধরা পড়েছে, যা মৌসুমের স্বাভাবিক উৎপাদনের পাঁচভাগের একভাগ।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ও ইলিশ গবেষক মো. আনিসুর রহমান বলেন, বার্ষিক ইলিশ উৎপাদনের অন্তত ৭০ শতাংশ আসে সাগর থেকে। সাধারণত ইলিশ ধরতে জেলেদের ১২ ঘণ্টার সমুদ্রপথ অতিক্রম করতে হয়।
সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপকূল থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে ট্রলার দিয়ে মাছ ধরা শুরু হয়েছে। অথচ আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস পৌঁছায় সর্বোচ্চ ৫৭ কিলোমিটার পর্যন্ত।
যেখানে আগস্ট মাস সাধারণত ইলিশ মৌসুমের প্রধান সময়, সেখানে এই মাসের ২৭ থেকে ২৯ তারিখের মধ্য বঙ্গোপসাগরে দুটি নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়েছে। অথচ এ সময় নদী ও উপকূলে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়ে এবং গৃহস্থের রান্নাঘর ভরে ওঠে ইলিশের ঘ্রাণে।
অক্টোবরের নিষেধাজ্ঞা শুরু হওয়া পর্যন্ত পর্যন্ত ইলিশ ধরার এই মৌসুম চলতে থাকে। কিন্তু ১৩ আগস্টের পর থেকে চারবার সতর্ক সংকেত জারি করা হয়। এ ছাড়া জুলাইয়ে চারবার, জুনে তিনবার ও মে মাসেও দুবার সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছিল।
মার্চ-এপ্রিলের দুই মাসব্যাপী সার্বিক নিষেধাজ্ঞার পর এই ঘনঘন সতর্ক সংকেত জারির ফলে মাছ ধরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
প্রতিটি সতর্ক সংকেত কার্যকর থাকে অন্তত তিন থেকে পাঁচ দিন। এ সময় ভারী বৃষ্টি, ৫০ কিলোমিটার গতির বাতাস এবং পাঁচ মিটার পর্যন্ত জোয়ার একসঙ্গে বা আলাদাভাবে দেখা দেওয়ার আশঙ্কা থাকে। বাতাস ও তাপমাত্রার মিথস্ক্রিয়ার কারণে গত প্রায় ১০০ দিনের মধ্যে ৩৯ থেকে ৬৫ দিনই বঙ্গোপসাগরে এমন আবহাওয়া বিরাজ করেছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ মোহাম্মদ আবুল কালাম মাল্লিক বলেন, এ বছর মৌসুমি বায়ু বেশ শক্তিশালী ছিল। সামগ্রিক আবহাওয়া অনেকের জন্য আরামদায়ক ছিল না।
আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে দেশের আবহাওয়া পরিস্থিতি
এ বছর বাংলাদেশে মৌসুমি বায়ু প্রায় চার দশকের মধ্যে সবচেয়ে আগে চলে এসেছে। সাধারণত জুনে শুরু হলেও এবার মে মাসের শেষ সপ্তাহেই সারা দেশে পড়তে শুরু করে মৌসুমি বায়ুর প্রভাব।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের ২০২৪ সালের ‘চেঞ্জিং ক্লাইমেট অব বাংলাদেশ’ নামক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৮১ সালের পর থেকে মে মাসের শেষ দিকে ১১ বার দেশে মৌসুমি বায়ু প্রবেশ করেছে, যার মধ্যে আটবারই প্রবেশ করেছে ২০০০ সালের পর।
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে মৌসুমি বায়ুর আগমন ও প্রকৃতি পরিবর্তিত হচ্ছে কিনা, তা এখনো গবেষণার বিষয়। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ সৃষ্টির হার কমছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত গবেষণাটি বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সেখানে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বাংলাদেশে আবহাওয়ার ধরন পাল্টে দিতে শুরু করেছে।
১৯৮১ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে প্রতি মৌসুমে ১০টির বেশি নিম্নচাপ সৃষ্টি হওয়ার ঘটনা ঘটেছে মাত্র ছয়বার। তার মধ্যে ১৯৮৯ সালে সর্বোচ্চ ১৩টি নিম্নচাপ তৈরি হয়েছিল। চলতি মৌসুমে ইতোমধ্যে ছয়টি নিম্নচাপ তৈরি হয়েছে, অথচ মৌসুমের শেষ মাস সেপ্টেম্বর এখনো বাকি। এই মাসেই সবচেয়ে বেশি নিম্নচাপ সৃষ্টি হওয়ার ইতিহাস রয়েছে।
এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি) এক পূর্বাভাসে বলেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মৌসুমি বায়ু ও ঘূর্ণিঝড় মৌসুম একসঙ্গে মিলে গিয়ে দশকে একবার শতাব্দী-বিরল জলোচ্ছ্বাস সৃষ্টি করতে পারে।
বিশ্বের অন্যতম জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ। বারবার নিম্নচাপ তৈরি হয়ে ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেওয়ার আশঙ্কা দেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদি বিপদ ডেকে আনছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
চলতি মৌসুমে নিম্নচাপজনিত বৈরি আবহাওয়ায় বাঁধ ভেঙেছে, ঘরবাড়ি-ফসল ভাসিয়ে নিয়েছে, বহু এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হয়েছে। এ সময় বন্ধ থেকেছে নৌপথে যোগাযোগ, গ্রাম-শহর প্লাবিত হয়েছে, পাহাড়ি এলাকায় আকস্মিক বন্যা ও ভূমিধসে শত শত মানুষ গৃহহীন হয়েছে।
আর্থিকভাবে সচ্ছল মানুষ এই বিপদের আঁচ তুলনামূলক কম পেলেও দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনে এর প্রভাব হয়ে উঠছে ভয়াবহ। বিশেষত কৃষক, রিকশাচালক, পরিবহনশ্রমিক বা নির্মাণশ্রমিকদের মতো মানুষ, যাদের জীবিকা প্রতিদিন বাইরে গিয়ে রোজগারের ওপর নির্ভরশীল, তাদের জন্য এসব দুর্যোগের সময় হয়ে ওঠে দুঃসহ।
চলতি বছরের জুন মাসে প্রায় রেকর্ড ভাঙা বৃষ্টি হয়েছে। টেকনাফে ১ হাজার ১৪৪ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে, যা স্বাভাবিকের চার গুন বেশি। একই মাসে খাগড়াছড়ির রামগড় ও ফেনীর পরশুরামেও স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে।
জুলাই মাসে টেকনাফেও স্বাভাবিকের চার গুন বেশি বৃষ্টি হয়েছে। কক্সবাজারে রেকর্ড হয়েছে ১ হাজার ৪০১ মিলিমিটার বৃষ্টি, যেখানে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৯৪৫ মিলিমিটার। নোয়াখালীতে ১ হাজার ১৭১ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে, যেখানে স্বাভাবিক ৭৩৯ মিলিমিটার, আর পরশুরামে ৮৭২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে, যেখানে সাধারণত ৫৬২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে।