ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন, পরবর্তী সরকারের কোনো পদে থাকব না : ড. ইউনূস

যুক্তরাষ্ট্রের ইউটাভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডেসার্ট নিউজের একটি নিবন্ধে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস লিখেছেন, আমি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছি, আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। পরবর্তী সরকারে আমি কোনো নির্বাচিত বা মনোনীত পদে থাকব না।
স্থানীয় সময় বুধবার (২০ আগস্ট) নিবন্ধটি প্রকাশ করেছে সংবাদমাধ্যমটি।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আমাদের সরকারের মূল লক্ষ্য হলো একটি স্বাধীন, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করা। যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের কাছে তাদের বক্তব্য তুলে ধরতে পারবে। বিদেশে বসবাসরত নাগরিকসহ সব ভোটারকে ভোট দেওয়ার সুযোগ নিশ্চিত করা বিশাল একটি কাজ, তবে আমরা তা সম্পন্ন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
পাঠকদের জন্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নিবন্ধটি তুলে ধরা হলো-
এক বছর আগে এই মাসেই, বাংলাদেশের সবচেয়ে সাহসী ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হাজারো শিক্ষার্থী — সমাজের সব স্তরের অসংখ্য মানুষের সমর্থনে — আমাদের জাতির ইতিহাসের এক অন্ধকার অধ্যায় শেষ করে দেয়। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন, যা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নির্মমভাবে দমন করা হয়েছিল, তারা একজন স্বৈরশাসককে ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য করে।
এরপর সৃষ্ট ক্ষমতার শূন্যতায়, ছাত্রনেতারা আমাকে আহ্বান জানান একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের জন্য, যার দায়িত্ব হবে দেশকে স্থিতিশীল করা ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পথনকশা তৈরি করা। প্রথমে আমি অস্বীকৃতি জানাই। কিন্তু তাদের জোরাজুরির পর, আমি ভাবলাম সেই সব তরুণদের জীবন উৎস্বর্গের কথা, যারা এত ত্যাগ স্বীকার করেছে। তখন আর পিছিয়ে আসা সম্ভব হয়নি।
২০২৪ সালের ৮ আগস্ট আমি নীতিনির্ধারক বিশেষজ্ঞ ও সিভিল সোসাইটির নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত মন্ত্রিসভাসহ শপথ গ্রহণ করি।
সরকারি চাকরিতে ন্যায্য নিয়োগ নিশ্চিতে শুরু হওয়া আন্দোলনই হয়ে ওঠে বিশ্বের প্রথম ‘জেনারেশন জেড’ বিপ্লব। এই আন্দোলন প্রমাণ করেছে, কিভাবে তরুণ প্রজন্ম এগিয়ে এসে মানবতার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ — যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন, দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও বৈষম্য মোকাবিলা করতে পারে।
আমরা সৌভাগ্যবান যে তারা “সময় আসার” অপেক্ষা করেনি। যখন সভ্যতা নানা পথে বিচ্যুত হচ্ছিল, তারা বুঝেছিল কাজ করার এখনই সময়।
স্বৈরশাসন থেকে গণতন্ত্রে রূপান্তর সফলভাবে এগোচ্ছে—এর অন্যতম বড় প্রমাণ ছিল, যখন দ্য ইকোনমিস্ট ২০২৪ সালে বাংলাদেশকে “বর্ষসেরা দেশ” ঘোষণা করে। তখন আমরা এতটাই ব্যস্ত ছিলাম অর্থনীতি পুনর্গঠন, নির্বাচন প্রস্তুতি ও লুট হওয়া বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ফেরত আনার কাজে যে, বিশ্বের এই স্বীকৃতি আমরা টেরই পাইনি। আমাদের যাত্রাপথে ডেজার্ট নিউজের ভালো কাভারেজের জন্যও আমরা কৃতজ্ঞ।
আমাদের প্রধান অগ্রাধিকারের একটি ছিল, আগের শাসনামলে যারা নৃশংসভাবে নিহত হয়েছেন এবং যারা আহত হয়েছেন — তাদের পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ প্রদান। পাশাপাশি, আমরা দুর্নীতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করা বিপুল অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের হিসাব অনুযায়ী, পূর্ববর্তী শাসকগোষ্ঠী ও তাদের সহযোগীরা প্রতি বছর ১০ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছে টানা ১৫ বছর ধরে। এ অর্থ উদ্ধারের লড়াই অপরিহার্য, কারণ এর গুরুত্ব অপরিসীম।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর আমি হতবাক হয়েছিলাম বিশৃঙ্খলার প্রসার দেখে। পুলিশ ছিল দায়িত্বহীন, বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার শূন্যপ্রায়, অর্থনীতি ধ্বংসস্তূপে, গণতন্ত্র ভেঙে পড়েছে। হাজার হাজার মানুষ রাষ্ট্রীয় নির্যাতনকেন্দ্রে বন্দি। প্রশাসনের কর্মকর্তারা, যারা ক্ষমতাসীন দলের প্রতি আনুগত্য দেখাতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে পদোন্নতি পাননি, তারাও ন্যায়বিচার দাবি করছিলেন।
একটু একটু করে আমরা পুনর্গঠন শুরু করেছি। স্বৈরতন্ত্রের বিরোধিতা করা রাজনৈতিক দলগুলো এবং নতুন গঠিত দলগুলো নতুন ধারণা, শক্তি ও কর্মতৎপরতা নিয়ে এগিয়ে এসেছে। সশস্ত্র বাহিনী, যারা ৫ আগস্ট আন্দোলন দমনে রক্তপাতের আহ্বান উপেক্ষা করে অসাধারণ সংযম প্রদর্শন করেছিল, তারা এখনও পেশাদারিত্ব বজায় রেখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সহায়তা করছে।
আমি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছি: আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। পরবর্তী সরকারে আমি কোনো নির্বাচিত বা মনোনীত পদে থাকব না।
আমাদের সরকারের মূল লক্ষ্য হলো একটি স্বাধীন, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করা—যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের কাছে তাদের বক্তব্য তুলে ধরতে পারবে। বিদেশে বসবাসরত নাগরিকসহ সব ভোটারকে ভোট দেওয়ার সুযোগ নিশ্চিত করা বিশাল একটি কাজ, তবে আমরা তা সম্পন্ন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
আমরা বৈদেশিক সম্পর্কও পুনর্গঠন করেছি, যাতে প্রতিবেশী ও বৈশ্বিক অংশীদারদের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক দৃঢ় হয়।
বিশ্বের অষ্টম জনবহুল দেশ হিসেবে, বাংলাদেশ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে এবং হওয়া উচিত। আমরা বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ ট্রাম্প প্রশাসন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর প্রতি, যার সঙ্গে সম্প্রতি আমার বাণিজ্য ও বিনিয়োগকেন্দ্রিক এক ফলপ্রসূ ও আন্তরিক বৈঠক হয়েছে। এটি দুই দেশের জন্যই লাভজনক হবে।
যুক্তরাজ্য, জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বিশ্বব্যাংক এবং জাতিসংঘও আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। আমরা একা নই।
নির্বাচন প্রস্তুতির পাশাপাশি আমরা এক বিস্তৃত সংস্কার পরিকল্পনা প্রস্তাব করেছি। এটি তৈরি হয়েছে বিশেষজ্ঞ, রাজনৈতিক দল ও সাধারণ নাগরিকদের সঙ্গে ব্যাপক পরামর্শের মাধ্যমে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবগুলোর একটি হলো সাংবিধানিক সংশোধনী, যা শক্তিশালী ভারসাম্য ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তুলবে—যাতে বাংলাদেশ আর কখনও স্বৈরশাসনে না পড়ে।
দেশের ভেতরে ও প্রবাসে থাকা বাংলাদেশের তরুণদের প্রতি আমি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাই। তারা দেখিয়েছে, উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সমস্যার প্রতি ক্ষোভকে কীভাবে পুনর্জাগরণের নকশায় রূপান্তর করা যায়। তাদের সাহস আমাদের মনে করিয়ে দেয়: অর্থবহ পরিবর্তনের জন্য পরিশ্রম ও ত্যাগ অনিবার্য।

তাদের উদাহরণ আমাদের আশা জোগায়, জেনারেশন জেড-এর পাশাপাশি এক্স, মিলেনিয়ালস এবং ডিজিটাল-নেটিভ জেনারেশন আলফারাও একসঙ্গে গড়ে তুলবে আমার স্বপ্নের “থ্রি জিরো ওয়ার্ল্ড” — শূন্য বেকারত্ব, শূন্য দারিদ্র্য এবং শূন্য কার্বন নির্গমন।
বাংলাদেশ যদি সত্যিই এমন একটি দেশে রূপান্তরিত হয় যেখানে প্রতিটি মানুষ নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে পারে, তবে সেটি হবে আগামী মাস ও বছরে কোটি বাংলাদেশির দৃঢ়সংকল্প, কল্পনাশক্তি ও সাহসের ফল।
আমাদের এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে যারা আমাদের সঙ্গে আছেন, বিশেষ করে ইউটার আমাদের বন্ধুদের মতো বৈশ্বিক সহযোগীরা, তারাই আমাদের বড় আশা এবং হয়তো শেষও।