ভূমি অফিস নয়, এখন সেবা মিলছে ঘরে বসেই

ভূমি ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি ও হয়রানির দীর্ঘ ইতিহাস ছাপিয়ে এখন ডিজিটাল যুগের অনেক ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। ভূমিকে জনবান্ধব করতে ভূমি মন্ত্রণালয় নিয়েছে একের পর এক যুগান্তকারী উদ্যোগ। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি ধাপ ভূমির সঙ্গে জড়িত। তাই এ খাতে স্বচ্ছতা ও নাগরিকবান্ধব সেবা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এএসএম সালেহ আহমেদ ইউএনবিকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে এসব তথ্য জানান।
সিনিয়র সচিব জানান, জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভূমি সেক্টরে ডিজিটাল রূপান্তরের গতি বেড়েছে। নাগরিক হয়রানি রোধ, দুর্নীতি বন্ধ এবং সেবার স্বচ্ছতা আনতে নেওয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ। ভূমি মন্ত্রণালয় এখন ‘ল্যান্ড সিঙ্গেল গেটওয়ে’ চালু করেছে—যার মাধ্যমে সকল ডিজিটাল ভূমি সেবা এক প্ল্যাটফর্মে পাওয়া যাচ্ছে।
তিনি জানান, বর্তমানে ঘরে বসেই নাগরিকরা অনলাইনে নামজারি, খতিয়ান, মৌজা ম্যাপ সংগ্রহ, ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধসহ একাধিক সেবা নিতে পারছেন। একাধিক সফটওয়্যার আপডেট করে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর থেকে পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয় এসব সেবা। বর্তমানে তা লাইভ রয়েছে।
সচিব বলেন, নাগরিকদের জন্য সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো—ভূমি অফিসে না গিয়েই মোবাইল অ্যাপ কিংবা কল সেন্টারের মাধ্যমে খতিয়ান সংগ্রহ বা নামজারি করা যাচ্ছে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিদেশ থেকেও +8809612316122 নম্বরে কল করে বা “ই-খতিয়ান” অ্যাপের মাধ্যমে সেবা পাওয়া সম্ভব।
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতায় জোর
সকল নামজারি আবেদন নির্ধারিত সময়সীমার (২৮ দিন) মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কোনো আবেদন অযথা ঝুলে থাকলে মনিটরিং কর্মকর্তারা তা যাচাই করবেন। ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তাদের জন্যও রয়েছে পরিষ্কার নির্দেশনা—নাগরিকের আবেদন পেন্ডিং রাখা যাবে না।
ভূমি সচিব বলেন, দুর্নীতি রোধে আমার কঠোর অবস্থান। ভূমি উপদেষ্টার নির্দেশে আমি মাঠ প্রশাসনে কঠোর নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
জিরো টলারেন্সে ভূমি মন্ত্রণালয়
ভূমি উপদেষ্টা ও সিনিয়র সচিব মহোদয়ের নির্দেশনায় মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও এসিল্যান্ড পর্যন্ত সবাই ভূমি সেবায় যুক্ত রয়েছেন। অভিযোগ পাওয়া মাত্র তদন্ত এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানিয়েছে মন্ত্রণালয়।
ভূমি ব্যবস্থাপনায় এই রূপান্তর কেবল প্রশাসনিক নয়, এটি একটি নাগরিক বিপ্লব—যেখানে ভূমি সেবাকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে মানুষের সময়, অর্থ এবং আস্থা—তিনটিকেই সংরক্ষণ করা হচ্ছে।
মেলাভিত্তিক সেবা
প্রতি বছর মে মাসে পালিত হয় ভূমি সেবা সপ্তাহ। এই সময়টিতে ভূমি মেলা ও ক্যাম্প আয়োজনের মাধ্যমে সরাসরি জনগণকে সেবা দেওয়া হয়। এতে করে সেবাগ্রহীতারা যেমন উপকৃত হন, তেমনি নীতি-নির্ধারকরা পান গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক পরামর্শ।
আইনগত সংস্কার
ভূমি সেবায় স্বচ্ছতা আনতে ইতোমধ্যে পাস হয়েছে একাধিক আইন: ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ২০২৩; ভূমি উন্নয়ন কর আইন, ২০২৩; ভূমি সংস্কার আইন, ২০২৩; হাট ও বাজার (স্থাপন ও ব্যবস্থাপনা) আইন, ২০২৩; স্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড টেন্যান্সি (সংশোধন) আইন, ২০২৩; বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা (সংশোধন) আইন, ২০২৩।
পাশাপাশি নতুন করে প্রণয়নাধীন রয়েছে
জলমহাল সুরক্ষা ও ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ-২০২৪, হাট ও বাজার বিধিমালা-২০২৫, ভূমি অধিগ্রহণ বিধিমালা-২০২৫, ভূমি জোনিং ও সুরক্ষা অধ্যাদেশ-২০২৫।
আর্থিক স্বচ্ছতা ও রাজস্ব বৃদ্ধির ধারা
অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে ও ‘এ-চালান’ সিস্টেম যুক্ত হওয়ায় ভূমি উন্নয়ন কর এখন সহজে প্রদান করা যাচ্ছে। দৈনিক প্রায় ১০-১২ কোটি টাকা ভূমি সেবা থেকে সরকারি কোষাগারে জমা হচ্ছে।
ভূমি সেবার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে সিনিয়র সচিব বলেন, ২০২৬ সালের মধ্যে এমন একটি সিস্টেম তৈরি করা হবে, যেখানে নাগরিকরা শুধুমাত্র এনআইডি দিয়েই তাদের ভূমির সব তথ্য জানতে পারবেন। ভূমি অধিগ্রহণে আইবাসের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ প্রদান, স্বয়ংক্রিয় ভূমি ডাটাব্যাংক, নামজারির অটো আপডেট এবং সরকারি জমি রক্ষা ব্যবস্থাও সংযুক্ত হবে ল্যান্ড সার্ভিস গেটওয়েতে।