রাষ্ট্র ও সমাজে প্রকৌশলী শহীদুল্লাহর চিন্তা ও কর্মকে বিস্তারের তাগিদ

প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ’র ৯৪তম জন্মদিনে তাঁকে স্মরণ করে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন সুহৃদ-স্বজনরা। রাজধানীর বাংলামোটরের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ৪০১ নম্বর কক্ষে বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) বিকেলে তাঁর কর্মময় জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে “প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ : নীরব দ্যুতির নাম” শিরোনামে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়।
স্থপতি ইকবাল হাবিব তাঁর প্রবন্ধে দেশের স্থাপত্য ও প্রকৌশল বিদ্যায় মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর নানা কীর্তির কথা তুলে ধরে বলেন, “সুযোগ থাকলেও তিনি সরকারি চাকরিতে যাননি। কারণ, নীতি যেখানে নত হয়, সেখানে শহীদুল্লাহ মাথা নোয়াতেন না। নিজেই প্রতিষ্ঠান গড়লেন। স্থপতি মাজহারুল ইসলামের সঙ্গে ‘বাস্তুকলাবিদ’ নামে স্থাপত্য-প্রকৌশল সংস্থা। চারুকলা, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়-যা যা দাঁড়িয়ে আছে আজ, তার শিকড়ের নিচে আছে শহীদুল্লাহর নাম, তাঁর গণনা, তাঁর অঙ্ক।”
শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর নানা কীর্তির কথা স্মরণ করে আরও আলোচনা করেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু, সাংবাদিক ও গবেষক ড. কাজল রশীদ শাহীন, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক শুভ কিবরিয়া ও বাংলাদেশ যুব ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক খান আসাদুজ্জামান মাসুম।
সাংবাদিক ও গবেষক ড. কাজল রশীদ শাহীন তাঁর বক্তব্যে বলেন, “শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতো এমন আলোকিত, ত্যাগী ও দেশপ্রেমিক মানুষকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা আমাদের দায় ও কর্তব্য। আমাদের দেশে তাঁর মতো বিরল ‘করুণার সাগর’ মানুষের মহত্ব ও আদর্শকে আমরা যদি নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে না পারি; তাহলে আমাদের সমাজে আলোকিত মানুষের জন্ম হবে না।”
সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক শুভ কিবরিয়া তাঁর সঙ্গে সাংবাদিক হিসেবে আন্তরিক সম্পর্কের স্মৃতিচারণ করেন। দিনাজপুরের ফুলবাড়িসহ দেশের খনিজসম্পদ নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের পদস্খলন দেখে বলেছিলেন, “আমি তো এজন্য বুদ্ধিজীবীদের ওপর মোটেই ভরসা করি না। একমাত্র সাধারণ জনগণ ছাড়া কারো ওপর ভরসা করা যায় না। ফুলবাড়ী আন্দোলনে যে সাধারণ জনগণ প্রাণ দিয়েছে সেই জনগোষ্ঠীই ভরসা। সুশীল সমাজের কয়জন ওই আন্দোলনে গেছে। এখনই বা কয়জন যায়? আমরা তো আন্দোলনের স্বার্থে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের কাছে মাঝেমধ্যে চাঁদা চাই। বুঝি তো তাদের ক্ষমতা? আর্থিক ত্যাগ যেটা সবচেয়ে নিম্নমানের ত্যাগ তাই তারা করতে চায় না। জেলের ঝুঁকি বা অন্য ঝুঁকি তো বাদই দিলাম।”
শুভ কিবরিয়া দীর্ঘদিন তাঁর সঙ্গে থেকে তাঁকে জানার বোঝার চেষ্টা করেছেন। সেই সব দিনের কথা উল্লেখ করে বলেন, একবার শহীদুল্লাহ ভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, নানারকম সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং ব্যক্তিকে প্রকাশ্য ও গোপনে আপনি বহু বছর ধরে আর্থিক সহায়তা দিয়ে এলেন। এ ক্ষেত্রে আপনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কী? ফলাফল কী?
তাঁর সহাস্য উত্তর, “খুব সুন্দর অভিজ্ঞতা। এটা খুব কাজে দিয়েছে। আমি একা যে কাজটা করতে পারতাম না, এখন সবাই মিলে তা করি। এই কাজটা সবাই মিলে করাটা খুব দরকার। একজনের কাজে তো হবে না। সেজন্য এই প্রচেষ্টাটা খুবই কাজে লেগেছে। আমার যেটুকু অর্থ ব্যয়, যেটুকু শ্রমব্যয়, এগুলো যত বেশি মানুষের ভেতরে শেয়ার করতে পারি ততই মঙ্গল। একা কতটুকু করা যায়। একা কিছুই করা যায় না। সেজন্য এটা একটা শেয়ারড এক্সপেরিয়েন্স। সবাই যেন মঙ্গলটা পায়। আমার ব্যর্থতা হচ্ছে, আরও বেশি পারলাম না কেন?”
শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর শিক্ষাজীবন দারিদ্র্য, সংগ্রাম আর কষ্টের মধ্যে কাটলেও সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে আজীবন এক লড়াকু মানুষ ছিলেন। পেশাগত প্রকৌশলী জীবনে তিনি অনন্য মেধায়, অসাধারণ দক্ষতায়, সততা, নিষ্ঠা ও শ্রমে দেশের প্রকৌশলী সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ও স্মরণীয় স্থানে নিজেকে আসীন করেছেন। দেশের তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষার আন্দোলনে আমৃত্যু ছিলেন সক্রিয়। “জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর” স্বামী বিবেকানন্দের এই অমিয় বাণীকে হৃদেয়ে ধারণ করে আজীবন পথ চলেছেন এই আলোকিত মানুষটি।
প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ-সৈয়দ আবুল মকসুদ ও স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন স্মৃতি সংসদ এই অনুষ্ঠানের অয়োজন করে। মো. আলমগীর কবিরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ।
উল্লেখ্য, শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯৩১ সালের ৩১ জুলাই খুলনার দৌলতপুরে জন্মগ্রহণ করেন। দৌলতপুর মুহসীন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৪৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় আরবিতে লেটারসহ প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন। ১৯৪৮ সালে তৎকালীন ব্রজলাল একাডেমী (পরে যার নাম হয় বিএল কলেজ) থেকে বিজ্ঞান বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় পূর্ব পাকিস্তান বোর্ডে সম্মিলিত মেধা তালিকায় ১৯তম স্থান অধিকার করেন। ১৯৫০ সালে একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএসসি পাস কোর্সে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান বোর্ডের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। ওই একই বছর ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়ে আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫৪ সালে আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (বর্তমান বুয়েট) থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ৭৯ শতাংশ নম্বর পেয়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে গোল্ড মেডেলিস্ট হিসেবে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।