দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকের প্রথম দিন কেন অংশ নেয়নি জামায়াতে ইসলামী, সেই ব্যাখ্যা দিয়েছেন দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। তিনি বলেন, ‘এটা ছিল অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে প্রতীকী প্রতিবাদ।’

আজ বুধবার (১৮ জুন) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমির দোয়েল হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা শুরু হয়। এর আগে ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্যায়ের দ্বিতীয় আলোচনায় যোগ দেয়নি জামায়াতে ইসলামী।

গতকালের বৈঠকে কেন অংশ নেননি জানতে চাইলে আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের লন্ডন সফরের কিছু কিছু বিষয়ে আমরা আপত্তি জানিয়ে ও প্রশ্ন করে আমরা একটি বিবৃতি দিয়েছি। সেটি হচ্ছে তার লন্ডন সফরের বিষয়ে আমাদের আনুষ্ঠানিক অবস্থান। এটা আমাদের সংগঠনের সর্বোচ্চ নির্বাহী পরিষদের বৈঠকে অনুমোদনের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’

ডা. তাহের বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা লন্ডন গিয়েছিলেন পুরস্কার আনতে ও পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনতে। পাশাপাশি, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত প্রধানের (তারেক রহমান) সঙ্গে লন্ডনে তার বৈঠক হয়েছে। সেটিকে আমরা স্বাগত জানিয়েছি। নির্বাচনের তারিখের বিষয়ে তিনি যে কথা বলেছিলেন, সে বিষয়ে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কারণ আমরা ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলের মধ্যেই নির্বাচন চেয়েছিলাম।’

জামায়াতের আপত্তির কথা জানাতে গিয়ে আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘এখন যে শর্তসাপেক্ষে ফেব্রুয়ারির কথা বলা হয়েছে, সেটাও আমাদের প্রস্তাবের মধ্যে আছে। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হলো—প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে একটি ভাষণ দিয়েছেন, সেখানে তিনি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছেন। এখানে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যদি কোনো পরিবর্তন হয়, সেটা হতে পারে। বিএনপির দাবি ছিল—আলোচনা করে যদি মনে করেন, নির্বাচন তারিখ পরিবর্তন হতে পারে, সেটা নিয়ে আপত্তি নেই। যেহেতু তিনি টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে অঙ্গীকার করেছেন, বাংলাদেশে এসে আবার কথাবার্তা বলে পুনর্বিবেচনা করতে পারতেন। কিন্তু, সেটা তিনি করেননি।’

জামায়াতের এই নেতা বলেন, ‘একটি দলের প্রতিনিধির সঙ্গে যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন—যেটা আমাদের অবাক করেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এটির আর কোনো উদহারণ খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিভিন্ন দেশে প্রধান বিরোধী দল কিংবা পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব করা বিভিন্ন দলের সঙ্গে বৈঠক হয়। কারণ, তারা তখন একটা স্ট্যাটাস পায়। বাংলাদেশে শতাধিক রাজনৈতিক দল আছে। এখন প্রধান উপদেষ্টা যার সঙ্গে কথা বলবেন, তার সঙ্গে কি একটি যৌথ বিবৃতি দেবেন? এটা বাংলাদেশে নজিরবিহীন। এটা সঠিক ছিল না। এতে বাকি সব দল যেমন বিব্রত হয়েছে, আমরাও তেমনটি অনুভব করছি।’

যৌথ সংবাদ সম্মেলন ও বিবৃতিতে আপত্তি জামায়াতের

একটি দলের ভারপ্রাপ্ত প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করে তাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যৌথ বিবৃতি ও সংবাদ সম্মেলন নিয়েই জামায়াতের আপত্তি ছিলে বলে জানিয়েছেন সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। তিনি বলেন, ‘কেবল জামায়াতে ইসলামী না, বাকি সব দলও বিব্রত হয়েছে। যৌথ বিবৃতি ও যৌথ সংবাদ সম্মেলন—এখানেই আমাদের আপত্তি। বিএনপির বিষয়ে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই।’

ডা. তাহের আরও বলেন, ‘এতে আমাদের মনে হয়েছে, প্রধান উপদেষ্টা তার নিরপেক্ষতা হারিয়েছে। আর এভাবে যদি চলতে থাকে, তাহলে যে সংস্কার কমিশন আছে, তাতে তারা খুব বেশি অগ্রসর হতে পারবে না। এটা অনেকটা পর্বতের মুষিক প্রসব করার মতো হবে। কার্যকারিতা হারাবে। সেখানে প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে আমরা গতকাল আসিনি।’

অন্তর্বর্তী সরকার থেকে জামায়াতের সাথে যোগাযোগ

এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী যে মান-অভিমান করেছে, তা ভাঙাতে দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। পরে তারা আশ্বস্ত হয়ে দ্বিতীয় দিনের বৈঠকে এসে অংশ নিয়েছেন। এমন তথ্য দিয়ে জামায়াতের এই নায়েবে আমির বলেন, ‘এরমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। গতকাল দুপুরে আমাদের আমিরে জামায়াতের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা। আমরা আমাদের কথা বলেছি, তিনি কিছুটা বুঝতে পেরেছেন—আশ্বস্ত করেছেন, তার সরকার নিরপেক্ষ থাকবে। কোনো বিশেষ দল বা গোষ্ঠীর প্রতি তারা অনুরক্ত না। আগামীতে এ বিষয়ে নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ ভূমিকা পালন করবেন এবং এ বিষয়ে আরও যত্নবান হবেন।’

‘সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা এখানে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা অচলাবস্থা চাই না, সবসময় অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা করেছি। কিন্তু কোনো কিছুর ব্যত্যয় হলে আমাদের কথা বলতে হবে’, যোগ করেন ডা. তাহের।

যেসব দল ক্ষমতায় যেতে পারছে না, নির্বাহী ক্ষমতা বিভক্ত করে তারা সরকারের হাত-পা বেঁধে দিতে চাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে, এ বিষয়ে জানতে চাইলে জামায়াতনেতা আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘কোন দল ক্ষমতায় যেতে পারবে, কোন দল পারবে না; জাতীয় স্বার্থের ক্ষেত্রে সেসব দেখা উচিত না। দেশের জন্য যেটা ভালো হবে, সেটা হওয়া উচিত।’

‘নির্বাচন সুষ্ঠু করতে যদি কঠোর না হয়, তাহলে আরেকটি শেখ হাসিনামার্কা নির্বাচন এ দেশকে রক্ষা করতে পারবে না’ বলেও মন্তব্য করেন জামায়াতের এই নেতা।

সংযত হতে বললেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে

‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হয়ে গেছে, আমরা প্রস্তুত আছি’—স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার এমন মন্তব্য সম্পর্কে ডা. তাহের বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়েছে, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কী, সেটা তিনি (উপদেষ্টা) বোঝেননি। যিনি একটি ভবনের তালা খোলার ব্যবস্থা করতে পারেননি একমাসেও, ৩০০টি আসনের আইনশৃঙ্খলা তিনি কীভাবে রক্ষা করবেন, সেটা বিস্ময়ের বিষয়।’

‘আমি তাকে সংযতভাবে কথা বলার অনুরোধ করছি। পাশাপাশি, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডও বোঝার চেষ্টা করার অনুরোধ করছি’, যোগ করেন জামায়াতের এই নায়েবে আমির।

নারীদের জন্য ১০০ আসন নিয়ে জামায়াতের কোনো আপত্তি নেই জানিয়ে ডা. আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘সেটা সংখ্যানুপাতিক হারে হতে হবে। আগে সেটা সমাধান না করে এ বিষয়ে কথা বলার কিছু নেই।’

এনসিসি গঠনের বিষয়ে একমত

এদিকে, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের বিষয়ে নীতিগতভাবে একমত হওয়ার কথা জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। দলটির নেতা ডা. তাহের বলেন, ‘আমরা নীতিগতভাবে বলছি, আমরা এনসিসির পক্ষে। এমন একটি সাংবিধানিক ভারসাম্যপূর্ণ কমিটি বা প্রতিষ্ঠান থাকা উচিত, তারা সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগের বিষয়ে ভূমিকা রাখবে। সেখানে প্রধানমন্ত্রী থাকবেন, প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা থাকবেন, স্পিকার ও উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষের (যদি হয়) ডেপুটি স্পিকার থাকবেন। এমন একটি কাঠামোর বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি।’

জামায়াতের এই নেতা বলেন, ‘তাদের মূল প্রস্তাব ছিল, সেখানে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান বিচারপতি থাকবেন। কিন্তু এ বিষয়ে আমরা আপত্তি করেছি এই জন্য যে একজন দেশের অভিভাবক হিসেবে ভূমিকা পালন করবেন, আরেকজন বিচারবিভাগীয় প্রধান। কাজেই তাদের এই কমিটিতে নিয়ে এলে এখানে যদি কোনো বিরোধ তৈরি হয়, তাহলে সেটা মীমাংসা করার আর কোনো সংস্থা থাকে না। সেকারণে আমরা বলেছি, প্রেসিডেন্ট ও প্রধান বিচারপতিকে বাদ রেখে এটিকে গঠন করার কথা। অনেকে এদিক-ওদিক বলেছেন। কিন্তু প্রায় দুয়েকটি দল ছাড়া বাকি সবাই এনসিসি গঠনের বিষয়ে নীতিগতভাবে একমত হয়েছি। পাশাপাশি, তিন বাহিনীর প্রধানদেরও এটির বাইরে থাকা ভালো বলে মনে করে জামায়াতে ইসলামী।’

এ সময়ে আরও উপস্থিত ছিলেন জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান ও হামিদুর রহমান আজাদ।