যশোরে দুই লাখেরও বেশি মানুষ পানিবন্দি, ১২ জনের মৃত্যু

যশোরের কেশবপুর ও মনিরামপুর উপজেলায় অবিরাম বৃষ্টি, উজান থেকে আসা পানি ও হরিহর নদীর উপচে পড়া পানিতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। দুটি উপজেলার ২৪টি ইউনিয়ন ও দুটি পৌরসভার ৫৬ হাজার পরিবারের দুই লাখ ২৫ হাজার ৫১১ জন মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে সাপের ছোবলে ও পানিতে ডুবে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ২৭ হাজার পরিবার এরই মধ্যে যশোর-সাতক্ষীরা সড়ক, উঁচু স্থান ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছে। প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বন্যার পানিতে এ দুটি উপজেলায় প্রায় ৪১৮ কোটি ৯৬ লাখ ১৫ হাজার ২৪২ টাকার সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। যশোর জেলা প্রশাসন থেকে এ পর্যন্ত পানিবন্দি মানুষের জন্য ১০৩ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
কেশবপুর ও মনিরামপুর প্রকল্প বাস্তবায়ন দপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি মাসের অবিরাম বর্ষণ, উজানের ও হরিহর নদীর উপচে পড়া পানিতে উপজেলা দুটির ২৪টি ইউনিয়ন ও দুটি পৌরসভা এলাকার ৫৬ হাজার পরিবারের দুই লাখ ২৫ হাজার ৫১১ জন মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে কেশবপুর উপজেলায় ২৬ হাজার পরিবারের এক লাখ পাঁচ হাজার হাজার ৫১১ ও মনিরামপুর উপজেলার ৩০ হাজার পরিবারের এক লাখ ২০ হাজার মানুষ। আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে ৬১টি। বসতবাড়িতে বন্যার পানি ওঠায় এরই মধ্যে ২৭ হাজার পরিবার যশোর-সাতক্ষীরা সড়কের পাশে টঙঘর বেঁধে এবং উঁচু স্থান ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছে। যারা এখনো গ্রামাঞ্চলে পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে, তারা গৃহপালিত পশুপাখি, সাপ, পোকা-মাকড়ের সঙ্গে বসবাস করছে। তাদের উদ্ধারে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সেখানে পৌঁছায়নি কোনো ত্রাণ বা সহযোগিতা।
মনিরামপুরে সাপের ছোবলে সাতজন ও পানিতে ডুবে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। প্রতিদিন পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। পানিবন্দি এলাকায় মানুষের খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দিয়েছে। আক্রান্ত হচ্ছে চর্মরোগ ও ডায়রিয়ায়।
কেশবপুর ও মনিরামপুর উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, যশোর জেলা প্রশাসন থেকে পানিবন্দি মানুষের জন্য ১০৩ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বন্যার পানিতে ডুবে দুটি উপজেলায় ১৭ হাজার ৪৮৩ হেক্টর জমির ১১২ কোটি ৯৭ লাখ ১৪ হাজার ৩০৫ টাকার আউশ, আমন ধান ও সবজির ক্ষতি হয়েছে। বন্যার পানিতে ১১ হাজার ৪৪০টি মাছের ঘের ও চাষি পুকুরের ৩০০ কোটি ছয় লাখ ১৭ হাজার ৯৩৫ টাকার মাছ ভেসে গেছে বলে মৎস্য দপ্তর জানায়। কেশবপুর ও মনিরামপুরের প্রভাবশালী ঘের ব্যবসায়ী মো. সুলতান জানান, তাঁর ২৪টি মাছের ঘের থেকে ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে।
পানি উঠে ৩০৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ বন্ধ হয়ে গেছে। বন্যার পানিতে ৩২৪টি গভীর ও অগভীর নলকূপ এবং ২৮ হাজার ৯৫৫টি ল্যাট্রিন ডুবে গেছে। বন্যার পানিতে ১৪ হাজার ৬৫৫টি বাড়িঘর সম্পূর্ণ ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রাণিসম্পদ কার্যালয় জানিয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১০৫টি গরু ও হাঁস-মুরগির খামার। ৭৫টি মসজিদ, মন্দির ও গির্জায় পানি উঠেছে। পানিতে ডুবে ১২৯ কিলোমিটার কাঁচা-পাকা রাস্তা নষ্ট হয়েছে।
যশোর-সাতক্ষীরা সড়কের চিনাটোলা থেকে মঙ্গলকোট পর্যন্ত পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ছোট-বড় যানবাহনসহ ভ্যান, নছিমন, করিমন ও অন্যান্য যানবাহনে চলাচলে অসুবিধায় পড়েছে জনসাধারণ। বন্যার পানির তোড়ে ১২৯টি গ্রামীণ ইটের সোলিং ও কাঁচা রাস্তা ধসে পড়েছে।
কেশবপুর শহরে তিন-চার ফুট পানি। শহরের অধিকাংশ পরিবার অন্যত্র চলে গেছে। যারা এখনো বাসাবাড়িতে আছে, তারা কোমর সমান পানিতে চলাচল করছে। এখনো হরিহর নদীর পানি হু হু করে কেশবপুর শহরে প্রবেশ করছে।
ড্রেজার দিয়ে হরিহর নদীর পলি অপসারণ করে বন্যার পানিনিষ্কাশন, দুর্গত এলাকা ঘোষণা এবং পর্যাপ্ত ত্রাণের দাবিতে কেশবপুর ও মনিরামপুর উপজেলার বাসিন্দারা প্রতিদিন মানববন্ধন, মিছিল ও সমাবেশ করছে।
ত্রাণ হিসেবে জেলা প্রশাসন থেকে ১০৩ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হলেও বন্যাকবলিত মানুষ বলছে, তারা ২১ দিন ধরে পানিবন্দি থাকলেও এখনো পর্যন্ত কেউ তাদের দেখতে যায়নি। এমনকি সরকারি সাহায্য-সহযোগিতাসহ কোনো খাদ্যসামগ্রীও তারা পায়নি। বানভাসি মানুষের সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তাঁরা শহরে বিত্তবানদের কাছ থেকে চাঁদা নিয়ে শুকনো খাবার কিনে দুর্গত মানুষের মাঝে বিতরণ করছেন। এ ছাড়া স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, সামাজিক সংগঠন, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকেও বানভাসি মানুষকে সাহায্য দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া কেশবপুর ও মনিরামপুর উপজেলা পরিষদ থেকে প্রায় ১০ লাখ টাকার শুকনো খাবার কিনে বানভাসিদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে।
কেশবপুর নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব মফিজুর রহমান নান্নু বলেন, ‘নদীর পলি আটকাতে এর আগে পানি উন্নয়ন বোর্ড কাশিমপুরে বাঁধ দিলেও গত দুই বছর কোনো বাঁধ না দেওয়ায় হরিহর নদীতে পলি পড়ে নদীর তলদেশ উঁচু হয়ে গেছে। যে কারণে অতিবৃষ্টি ও উজানের পানিনিষ্কাশনে বাধাগ্রস্ত হয়ে হরিহর নদীর পানি উপচে শহর এবং গ্রামাঞ্চলে ডুকে মানুষের বাড়িঘর ও ফসলের মাঠ তলিয়ে গেছে। এ ছাড়া বন্যা বা জলাবদ্ধতার আরেকটি কারণ মাছের ঘের। ঘেরমালিকরা বৃষ্টির বা উজানের পানিনিষ্কাশনের পথ না রেখেই ঘের করেছেন। বৃষ্টি বা উজানের পানিনিষ্কাশনে প্রতিটি বিলে সরকারি খাল থাকলেও ঘেরমালিকরা সেসব খাল দখল করে মাছের ঘের করেছেন। এসব খাল দখলমুক্ত এবং জরুরি ভিত্তিতে ড্রেজার দিয়ে হরিহর নদীর পলি অপসারণ করলেই দ্রুত বাড়িঘর ও শহর থেকে পানিনিষ্কাশন সম্ভব।’
কেশবপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা শরীফ রায়হান কবির জানান, কেশবপুরের ১১টি ইউনিয়ন ও পৌরসভা এলাকার মানুষ বন্যার পানিতে ভীষণ কষ্টে আছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষজনকে সার্বিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছে। যারা এখনো পানিবন্দি অবস্থায় আছে, তাদের উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্র ও উঁচু স্থানে আনা হয়েছে।
মনিরামপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কামরুল হাসান জানান, বন্যা ও উজানের পানিতে মনিরামপুরে এক লাখ ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ৩৯টি আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়া আরো ৩৭টি উঁচু স্থানে মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। পানিতে ডুবে ৬৭ কোটি টাকার ফসল নষ্ট হয়েছে, ভেসে গেছে ১৯৪ কোটি টাকার মাছ। খাদ্য বা ত্রাণের কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা হলো জলাবদ্ধতা। এখানকার হরিহর নদী ও ভবদহকেন্দ্রিক নদীগুলো পলিতে ভরাট হয়ে গেছে। আগামী তিন-চারদিনের মধ্যে খননকাজ শুরু হলে দ্রুত বন্যার পানিনিষ্কাশন হবে।
এদিকে গতকাল শুক্রবার কেশবপুল মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে ত্রাণ বিতরণের সময় জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেক বলেন, আগামীকাল রোববার থেকে ড্রেজার দিয়ে নদীর পলি অপসারণের কাজ শুরু হবে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে বন্যার পানি সরে যাবে এবং মানুষজন বাড়িঘরে ফিরে যেতে পারবে।
এ ব্যাপারে কেশবপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী আবদুল মোতালেব জানান, ড্রেজার দিয়ে নদীর পলি অপসারণ করা হবে। তবে ড্রেজার মেশিনটি কবে নাগাদ হরিহর নদীতে আসবে তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলতে পারবে।