শতবর্ষে কিশোরগঞ্জের আজিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়

কিশোরগঞ্জ জেলা সদরের ঐতিহ্যবাহী আজিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় পার করেছে শতবর্ষ। বিদ্যাপীঠটির শতবর্ষ উপলক্ষে আগামী কাল রোববার থেকে শুরু হচ্ছে তিনদিনব্যাপী অনুষ্ঠান। শতবর্ষের এ অনুষ্ঠানকে ঘিরে যেন উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে কিশোরগঞ্জ সদরজুড়েই।
এর মধ্যেই শহরের বিভিন্ন স্থানে নির্মিত হয়েছে সুদৃশ্য তোরণ। প্রতিষ্ঠানটির বিশাল প্রাঙ্গণজুড়ে ঝলমলে আলোকসজ্জা জানান দিচ্ছে জমকালো উৎসবের আবহের কথা। অনুষ্ঠানের প্রথম দিন প্রধান অতিথি হিসেবে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ উপস্থিত থাকবেন বলে জানান আবদুল হামিদ মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. আ ন ম নৌশাদ খান।
১৯১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এ বিদ্যালয়ের শতবার্ষিকী অনুষ্ঠান যথাযোগ্য মর্যাদায় আড়ম্বরপূর্ণ পরিবেশে উদযাপনের লক্ষ্যে এরই মধ্যে গঠিত হয়েছে ১০১ সদস্যবিশিষ্ট শতবর্ষ পূর্তি উদযাপন পরিষদ।
ডা. আ ন ম নৌশাদ খান জানান, সুষ্ঠুভাবে উৎসব আয়োজনের লক্ষ্যে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। তিন দিনব্যাপী কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে আলোচনা সভা, প্রাক্তন ছাত্রদের অংশগ্রহণে স্মৃতিচারণা ও দেশের বিশিষ্ট শিল্পীদের অংশগ্রহণে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা বিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র ও শিক্ষকদের উৎসবে যোগদানের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
উৎসবের মিডিয়া উপকমিটির আহ্বায়ক বিশিষ্ট গবেষক ও লেখক মুহাম্মদ আব্দুল লতিফ জানান, জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার সাঁতারপুর গ্রামের বাসিন্দা বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী ও দানবীর মুন্সী আজিমউদ্দিন আহমদ পশ্চাৎপদ এ এলাকায় শিক্ষার আলো জ্বালাতে ১৯১৬ সালে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন।
সে বছরের ২৮ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জ শহরের স্টেশন রোডসংলগ্ন বাসভবনের সামনে একটি টিনের তৈরি ঘরে আজিমউদ্দিন উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়। সে বছর তৃতীয় শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্র ভর্তি করা হয়। পরে রেললাইনের পূর্ব পার্শ্বে শোলাকিয়া এলাকায় বর্তমান অবস্থানে স্কুলের নিজস্ব জমি কিনে নতুন বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ করে স্থানান্তর করা হয়। ১৯১৭ সালে বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণি এবং পরের বছর দশম শ্রেণির শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়।
হীরণ চন্দ্র গোস্বামী প্রথম প্রধান শিক্ষক হিসেবে বিদ্যালয়ের কাজ পরিচালনার পর প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে যোগদান করেন বসন্ত কুমার চক্রবর্তী। শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর মাত্র ছয় বছরের মধ্যেই আজিমউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হয় ইতিহাসের পাতায়। তৎকালীন বাংলা, বিহার, ঊড়িষ্যা, আসাম, ব্রহ্মদেশ মিলিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২২ সালে এই বিদ্যালয়ের ছাত্র রেবতী মোহন বর্মণ মেট্টিকে মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করেন। ফলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এ বিদ্যালয়টিকে স্থায়ী মঞ্জুরী প্রাপ্তির জন্য তালিকাভুক্ত করে। এর ফলে দেশ-বিদেশে আজিমউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের নাম ছড়িয়ে পড়ে।
কিন্তু ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের ফলে পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে দেশত্যাগ করেন প্রধান শিক্ষক বসন্ত কুমার চক্রবর্তী এবং বেশ কজন খ্যাতিমান শিক্ষকসহ অধিকাংশ ছাত্র। এ সময় ১৯৫১ সালে হাল ধরলেন প্রধান শিক্ষক মতিউর রহমান।
১৯৭০ সালে এ বিদ্যালয়ের শিক্ষক স্কাউটার মো. রমজান আলীর নেতৃত্বে পাকিস্তান জাতীয় জাম্বুরিতে স্কাউট ইউনিটে যোগদান করে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে।
১৯১৬ সনে প্রতিষ্ঠার পর থেকে অদ্যাবধি রত্নগর্ভা আজিমউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় শত বছরের পথের বাঁকে বাঁকে অসংখ্য জ্ঞানী-গুণী, কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী-সাংবাদিক, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, ক্রীড়াবিদ, মুক্তিযোদ্ধা, ভাষাসৈনিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন অনেক খ্যাতিমানদের জন্ম দিয়েছে, যা শিক্ষার প্রসার ও সমাজ উন্নয়নের পাশাপাশি দক্ষ, সৃজনশীল ও দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ জনগোষ্ঠী গঠনে ব্যাপক অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে।
এ বিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার গুরুদায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রথম উপাচার্য ড. এম ওসমান গনি, প্রখ্যাত নাট্যকার ও অভিনেতা আবদুল্লাহ আল মামুন, বিখ্যাত ফুটবলার চুনিলাল গোস্বামী ও বিপ্লবী রেবতী মোহন বর্মণ ছিলেন এ বিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মরহুম মতিউর রহমানের সুযোগ্য ছেলে আতিকুর রহমান আতিক একাত্তরের ৪ জুলাই ভৈরবে একটি অপারেশন করতে গিয়ে গ্রেনেডের আঘাতে শহীদ হন। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে শহীদ হন এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এ বি এম সফিউদ্দিন, তাহের উদ্দিন ভূঁইয়াসহ অনেকেই।