অস্তিত্ব, মর্যাদা আর চ্যালেঞ্জের মুখে তিন দল

রাঙামাটি পৌরসভায় নিকট অতীতে পৌর নির্বাচন তো দূরের কথা, জাতীয় নির্বাচনেও বোধ হয় জয়ের জন্য এতটা মরিয়া হতে দেখা যায়নি আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল জনসংহতি সমিতিকে। অতীতেও স্থানীয় বা জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়েছে দলগুলো। কখনো হেরেছে, কখনো বা জিতেছে। কিন্তু জয়ের জন্য এতটা অসহিষ্ণু, আগ্রাসী আর হতে দেখা যায়নি। এবারের পৌরসভা নির্বাচন যেন এই তিন দলের জন্যই মর্যাদা, অস্তিত্ব আর চ্যালেঞ্জের নির্বাচন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নানা দিক দিয়েই রাঙামাটি পাহাড়ের সব প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ কার্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্র। এখানে রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, ইউএডিপি-সিএইচটিডিএফ, সিএইচটিআরডিপির মতো প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয়। ফলে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিকভাবেই এ শহরের গুরুত্ব অপরিসীম। ফলে সংগত কারণেই এই শহর নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া তিন দলই।
আওয়ামী লীগের অস্তিত্বের লড়াই
২০১১ সালে রাঙামাটি পৌরসভা নির্বাচনে পরাজয়ের মধ্য দিয়েই রাঙামাটি জেলায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক পরাজয় শুরু। এর পর অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে পুরো জেলায় দলটির ভরাডুবি হয়। সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সারা দেশে ভূমিধস বিজয়ের মধ্যেও রাঙামাটিতে পরাজয়ে দৃশ্যত বেকায়দায় পড়ে যায় আওয়ামী লীগ। ফলে ক্ষমতায় থেকেও ক্ষমতাহীন থাকার এক রূঢ় কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয় দেশের প্রধান এই দলটি। বিষয়টি স্থানীয়ভাবে দলটির জন্য যেমন বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করে, তেমনি জাতীয়ভাবেও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে স্থানীয় নেতাদের সক্ষমতা ও যোগ্যতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ফলে এবার আর ঝুঁকি নিতে চায় না স্থানীয় নেতৃত্ব। দলটির নেতাকর্মী ও শীর্ষ নেতাদের বড় অংশটিই মনে করছে, এবারো যদি পৌর নির্বাচনে পরাজিত হন তারা, তবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনেক শীর্ষ নেতাই ইমেজ সংকটে পড়বেন। তাই অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এবার জয়ের জন্য মরিয়া দলটি, যেকোনো মূল্যেই জয় চাই তাদের।
বিএনপির মর্যাদার লড়াই
২০১১ সালে পৌর নির্বাচনে বিজয়ের মাধ্যমে রাঙামাটি পৌরসভার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো মেয়র পদটি দখল করে বিএনপি। কিন্তু সরকারি দলের সহযোগিতাহীনতার কারণে বিপাকে পড়েন মেয়র সাইফুল ইসলাম ভুট্টো। রাঙামাটির যে দুটি উপজেলা ও দুই পৌরসভায় বাঙালি চার নেতা নেতৃত্বে আছেন, তাঁরা সবাই বিএনপির রাজনীতির সঙ্গেই জড়িত। সংগত কারণেই রাঙামাটি পৌরসভাটি স্থানীয় বিএনপির রাজনীতি টিকিয়ে রাখার জন্যও ভীষণ জরুরি। দলটিতে নানা বিভক্তি রয়েছে। তার পরও কয়েক দিন আগে জেলা সম্মেলনে দলের প্রভাবশালী নেতা দীপেন দেওয়ান জেলা সভাপতির পদ হারিয়েছেন। নতুন কমিটি দায়িত্ব নেওয়ার পর তাঁদের সামনে এটাই প্রথম স্থানীয় সরকার নির্বাচন। নির্বাচনে বিজয় ধরে রাখাটা তাঁদের জন্য খুবই জরুরি।
বিএনপির জন্য বিপদ হয়েই আছেন দীপেন অনুসারী হিসেবে পরিচিত ‘বিদ্রোহী’ মেয়র পদপ্রার্থী রবিউল আলম রবি। সভাপতি পদ হারানো দীপেন দেওয়ান ধানের শীষের পক্ষে মাঠে থাকলেও তাঁর অনেক অনুসারীই রয়েছে রবির পক্ষে।
জনসংহতি সমিতির চ্যালেঞ্জ
সর্বশেষ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে জেলার অধিকাংশ উপজেলায় চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে জয়ের পর ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনেও রাঙামাটিতে বিজয়ী হয় ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে অস্ত্র সমপর্ণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরা সাবেক গেরিলাদের সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। প্রকাশ্য রাজনীতি শুরুর পর এই প্রথম রাঙামাটি পৌরসভায় মেয়র পদে সরাসরি নিজেদের প্রার্থী দিয়েছে দলটি। এখানে দলটির নেতা গঙ্গা মানিক চাকমা নারকেল গাছ প্রতীকে মেয়র পদে নির্বাচন করছেন। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত না হওয়ায় দলটির প্রার্থী যদিও স্বতন্ত্র পরিচয় বহন করছে, কিন্তু সংসদ নির্বাচনের মতো এই নির্বাচনকে বেশ গুরুত্বসহকারেই নিয়েছে চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে থাকা দলটি।
দলটি মনে করছে, উপজেলা, সংসদ নির্বাচনে জনরায় পাওয়ার পর দলটি যদি পৌরসভায়ও নিজেদের প্রার্থীকে বিজয়ী করতে পারে, তবে নিজেদের প্রতি শতভাগ জনসমর্থনের প্রমাণ যেমন সরকারকে দেখাতে পারবে, একইভাবে স্থানীয় সরকারের এই জয়কে কাজে লাগিয়ে চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে আগামী দিনের আন্দোলন-সংগ্রামেও বাড়তি প্রণোদনা পাবে দলটির কর্মীরা। তাই এবারের পৌরসভা নির্বাচনকে নিজেদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবেই ভাবছে পাহাড়ের প্রভাবশালী এই দলটি।
সবকিছু মিলিয়ে নৌকার আকবর, ধানের শীষের ভুট্টো আর নারকেল গাছের গঙ্গা মানিকের নির্বাচন বা ব্যক্তিগত লড়াইকে ছাড়িয়ে এবারের পৌর নির্বাচন এখন রাঙামাটি আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব, বিএনপির মর্যাদা আর জনসংহতির জন্য চ্যালেঞ্জের এক নির্বাচন হয়ে উঠেছে।