নারাজি খারিজ, ১৩ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন মামলায় পুলিশের দেওয়া অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে একটি মামলার বাদীর নারাজি আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন আদালত। আজ বুধবার জেলার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম সাইদুজ্জামান শরিফ এই আদেশ দেন। একই সঙ্গে সাত খুনের দুটি মামলার পলাতক র্যাবের আট সদস্যসহ ১৩ আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। সেই সঙ্গে তাঁদের মালামাল জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
পলাতক যেসব আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে, তাঁরা হলেন অভিযোগপত্রভুক্ত প্রধান আসামি নূর হোসেন, তাঁর সহযোগী নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার কুড়িপাড়া এলাকার সেলিম, সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকার সানাউল্লাহ, ব্যবস্থাপক শাহ্জাহান ও জামাল উদ্দিন, র্যাব ১১-এর সদস্য সার্জেন্ট যশোরের এনামুল কবীর, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) নাটোরের কামাল হোসেন, করপোরাল নওগাঁর মোখলেছুর রহমান, সৈনিক নাটোরের আবদুল আলিম, ফেনীর মহিউদ্দিন মুন্সী, বরিশালের আল আমিন শরীফ, ময়মনসিংহের তাজুল ইসলাম ও কনস্টেবল শরীয়তপুরের হাবিবুর রহমান। এঁদের মধ্যে নূর হোসেন ও সেলিম বর্তমানে ভারতের কারাগারে আটক আছেন।
আদালতে একটি মামলার বাদী এবং নিহত কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি উপস্থিত ছিলেন। তিনি এই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করবেন বলে জানিয়েছেন। অপরদিকে আইনজীবী চন্দন সরকার ও তাঁর গাড়ির চালক ইব্রাহিম হত্যার ঘটনায় করা অপর মামলায় দাখিল করা অভিযোগপত্রে বাদী বিজয় কুমার পাল আদালতে সন্তোষ প্রকাশ করেন।
নারায়ণগঞ্জের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী চন্দন সরকার ও প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ সাত খুনের দুটি মামলায় গত ৮ এপ্রিল র্যাবের চাকরিচ্যুত তিন কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ, কমান্ডার এম এম রানা ও মেজর আরিফ হোসেনসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। এর বিরুদ্ধে গত ১১ মে প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ পাঁচজনকে অপহরণের পর হত্যা মামলার বাদী সেলিনা ইসলাম বিউটি আদালতে না রাজি আবেদন করেন। গত ৭ জুন এর ওপর শুনানি হয়।
এর আগে আজ সকালে কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে র্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) ও লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) এম এম রানাসহ ৩২ জনকে আদালতে হাজির করে পুলিশ।
জেলার অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর কে এম ফজলুর রহমান জানান, ৭ খুনের ঘটনায় পৃথক দুটি মামলার মধ্যে একটি মামলার বাদী অভিযোগপত্রের বিষয়ে কোনো আপত্তি করেননি। অপর মামলার বাদীর না রাজি আবেদন নামঞ্জুর করে আদালত দুটি মামলায় অভিযোগপত্র গ্রহণ করেছেন। সেই সঙ্গে পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি এবং তাঁদের মালামাল ক্রোকের নির্দেশ দিয়েছেন।
এ ব্যাপারে মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী ও জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আমরা এই নারাজি আবেদন নামঞ্জুরে সংক্ষুব্ধ হয়েছি। এই আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাব।’
সাখাওয়াত হোসেন বলেন,এই হত্যাকাণ্ডটি যদি চারটি অংশে বিভক্ত করা হয় তা হবে পরিকল্পনা, অর্থের জোগান, অপহরণ, গুম ও হত্যা। পরিকল্পনা ও অর্থের জোগানের বিষয়টি তদন্তকারী কর্মকর্তা কোনোভাবেই উদঘাটন করতে পারেননি। এই হত্যাকাণ্ডের পর থেকে এজাহারভুক্ত যে পাঁচজনকে বাদ দেওয়া হয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে এজাহারে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল। কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তা তাঁদের গ্রেপ্তার বা তাঁদের মালামাল ক্রোকেরও কোনো আবেদন করেননি। তদন্ত কর্মকর্তা প্রথম থেকে ওই আসামিদের প্রতি শিথিল ছিলেন। আমরা মনে করি, এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির আত্মীয়স্বজন জড়িত রয়েছে। সরকারি দলের লোকজন জড়িত রয়েছে।’
এদিকে আজ নারাজি আবেদন খারিজ হয়ে যাওয়ার পর নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘নূর হোসেন,সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইয়াসিন মিয়া, হাসমত আলী হাসু,আমিনুল ইসলাম রাজু,আনোয়ার হোসেন আশিক ও ইকবাল হোসেনকে আসামি করে মামলা করা হলেও নূর হোসেন ছাড়া এজাহারভুক্ত অপর পাঁচ আসামিকে অভিযোগপত্র থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এজাহারভুক্ত একজন আসামিকে গ্রেপ্তার ছাড়াই কীভাবে অভিযোগপত্র দাখিল করা হলো। গ্রেপ্তার হওয়া আলী মোহাম্মদসহ কয়েকজন আসামির ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে আরো কয়েকজন আসামির নাম এসেছে। তাঁদের নামও অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। আমরা উচ্চ আদালতে আপিল করব।’
সেলিনা অভিযোগ করেন, ‘আসামি ইকবাল,রাজু এলাকায় এসে অস্ত্র নিয়ে আমাদের প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছেন। তাঁরা নাকি দেড় কোটি টাকা দিয়ে মামলা থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন। ছয় কোটি টাকা নিয়ে আমার স্বামীসহ সাতজনকে অপহরণের পর খুন করা হলো। আমরা তো সঠিক বিচার পাইনি।’
এদিকে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ফজলুর রহমান বলেন, আদালত যুক্তিযুক্ত আদেশই দিয়েছেন।
অভিযোগপত্র গ্রহণের বিষয়ে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন বলেন,‘মামলাটি দীর্ঘ প্রায় ১১ মাস তদন্ত শেষে স্বচ্ছ,পেশাদারিত্ব নিয়ে যে নির্ভুল অভিযোগপত্র দাখিল করেছি, সেটি আজকে আদালতে গৃহীত হয়েছে। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারে উদ্যোগ নেওয়া হবে। ভারতের কারাগারে আটক নূর হোসেন ও তাঁর সহযোগীকে ফেরত আনার সব রকম চেষ্টা চলছে। তাঁরা যখনই দেশে আসবে, তখনই গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করা হবে।’
মামলার বাদীকে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে পুলিশ সুপার বলেন, মামলার বাদী-বিবাদী সবার নিরাপত্তা দিতে পুলিশ বদ্ধপরিকর।
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, তাঁর বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন ও গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম এবং আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তাঁর গাড়িচালক ইব্রাহীম অপহৃত হন। পরে ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ছয়জনের ও ১ মে আরেকজনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি ও আইনজীবী চন্দন সরকারের মেয়ের জামাই বিজয় কুমার পাল বাদী হয়ে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা মডেল থানায় দুটি মামলা করেন।
এই ঘটনায় র্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ মোট ৩২ জনকে আটক করে পুলিশ। হত্যার দায় স্বীকার করে র্যাবের ১৭ জনসহ ২২ জন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন এবং ঘটনার সাক্ষী হিসেবে র্যাব সদস্যসহ ১৭ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। চলতি বছরের গত ৮ এপ্রিল মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মামুনুর রশিদ মণ্ডল নূর হোসেন,র্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
অভিযোগপত্রভুক্ত ২২ আসামি কারাগারে : বর্তমানে র্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ১৭ জন কারাগারে আটক রয়েছেন। এঁরা হলেন র্যাব-১১ ব্যাটালিয়নের সাবেক অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন,লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মাসুদ রানা, উপপরিদর্শক পূর্ণেন্দু বালা, এএসআই বজলুর রহমান,আবুল কালাম আজাদ, হাবিলদার এমদাদুল হক ও নাসির উদ্দিন, কনস্টেবল শিহাব উদ্দিন, বাবুল হাসান, আরওজি-১ আরিফ হোসেন, ল্যান্স নায়েক হীরা মিয়া, বেলাল হোসেন, ল্যান্স করপোরাল রুহুল আমিন, সিপাহী আবু তৈয়ব, নুরুজ্জামান ও আসাদুজ্জামান নূর। এ ছাড়া কারাগারে আছেন নূর হোসেনের পাঁচ সহযোগী সিদ্ধিরগঞ্জের মোর্তুজা জামান চার্চিল, আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান দীপু, রহম আলী ও আবুল বাশার।