লকডাউনে মানিকগঞ্জের দেশি মুড়ির চাহিদা নেই

রমজান মানেই ইফতার, আর ইফতারে মুড়ি থাকবে না তা কল্পনাই করা যায় না। কিন্তু এবারের রমজানে করোনার কারণে মানিকগঞ্জে মুড়ির চাহিদা একদমই নেই। উৎপাদনকারী ও বিক্রেতার মধ্যে অনেকটা হতাশা কাজ করছে।
মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার নবগ্রাম ইউনিয়নের সরপাই গ্রাম। যেখানে এক সময় মুড়ি ভাজার গন্ধে চারপাশ ভরে যেত সেখানে এখন আর সেই গন্ধ পাওয়া যায় না। অনেক পার্বণের আগমনী ভাব ছিল এখানে। কিন্তু মিলের মুড়ির কারণে দেশীয় পদ্ধতিতে মুড়ি তৈরির আগ্রহ এ এলাকায় তেমন একটা দেখা যায় না। সেইসঙ্গে দামের বিষয়টি তো রয়েই গেছে।
‘বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই দ্যাখতাছি আমার বাপ-ভায়েরা এই মুড়ির ব্যাবসা করে আসতাছে। প্রতি বছরই রমজান এলে পুরো গ্রাম ধইরা প্রত্যেক বাড়িতে মুড়ি ভাজতো। কিন্তু এখন মেলের (মিল) মুড়ি আসাতে হাতেভাজা মুড়ি কম চলে। আমাদের এলাকায় এখন কেবল আমার মা-ই মুড়ি ভাজেন।’ এভাবেই নিজের আক্ষেপের কথা জানান সরপাই গ্রামের আইভী বেগম (৩৫)।
এরই মধ্যে রমজানের এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। কিন্তু গ্রাহকদের মুড়ির প্রতি তেমন একটা চাহিদা দেখা যাচ্ছে না। মুদি দোকানেও তেমন গ্রাহক নেই এ মুড়ির। চলমান লকডাউনে মুড়ির চাহিদা নেই বললেই চলে।
মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডের মুদি দোকানী কার্তিক চন্দ্র শীল বলেন, ‘আগে দেশি মুড়ির চাহিদা ছিল কিন্তু এখন করোনার কারণে চাহিদা কম। মিলের মুড়ি ৭০ টাকা কেজি আর দেশি মুড়ির দাম একশ চল্লিশ টাকা। দামের কারণে মানুষ দেশি মুড়ি নেয় না। টার্গেট পূরণ হইবো না করোনার কারণে। আগে ভালো বেচতাম। ঢাকা থেকেও লোক আসতো। এখন তো বেচাকেনাই নাই।’

কার্তিক চন্দ্র আরও বলেন, ‘আগে যেখানে দৈনিক দেড়শ থেকে তিনশ কেজি মুড়ি বিক্রি করতাম এখন পঞ্চাশ কেজিও বিক্রি করতে পারি না। বিশ-ত্রিশ বছর ধরে মুড়ি বিক্রি করি কিন্তু এবারের মতো খারাপ অবস্থা আগে হয় নাই। এই মুড়ি সাধারণত ঢাকার লোকেই নেয়। লকডাউনের কারণে তো লোক আসতেই পারতেছে না।’
দেশি মুড়ির চাহিদা কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে কার্তিক জানান, মিলের মুড়ি যেখানে দৈনিক পাঁচশ বস্তা ভাজা যায় সেখানে দেশি মুড়ি ভাজতে পারে বিশ থেকে ত্রিশ কেজি। সেক্ষেত্রে উৎপাদন খরচটাও একটা ব্যাপার।
কালের বিবর্তনে একদিন হয়তো দেশি মুড়ির চাহিদা আর এদেশে থাকবে না। স্বাদের গুণগত মান নয়, ভোক্তা চায় সুলভ মূল্যের পণ্য। একদিন যেখানে মুড়ি ভাজার উষ্ণ গন্ধে পুরো গ্রাম থাকতো মুখরিত, সেখানে এখন আর সে দৃশ্য তেমন দেখা যায় না।
মানিকগঞ্জের নবগ্রাম ইউনিয়নের সরপাই এলাকার সখিনা বেগম বলেন, ‘আমার বিয়্যা হইয়ে আসার পর থ্যাইকেই আমরা মুড়ি ভাজার কাজ কইরে আসতাছি। আগে এইখ্যানে সবাই মুড়ি ভাজতো। রোজার সময় ত্রিশ দিনের ত্রিশ দিনই এক বস্তা কইরা ভাজতাম। কিন্তু মিলের মুড়ি আসনে (আসায়) এই মুড়ির চাহিদা কইম্যা গেছে। সবাই মুড়ি ভাজা বাদ দিছে। আমি আর বাদ দেই নাই। যে পরিমাণ কাজ করি সে পরিমাণ চাহিদা নাই। মজুরিও পাই না।’
সখিনা বেগম আরও বলেন, ‘আমরা তো কিস্তি তুইল্যা ধান আনি। এখন তো কিস্তিও তুলতে পারুম না, ধানও আনতে পারুম না। করোনায় তো আমাগো বসায় দিছে।’
একাই দুই দিনে সখিনা দুই মণ মুড়ি ভাজতে পারেন। কিন্তু মজুরি পড়ে মাত্র আড়াইশ টাকার মতো। পুরো রমজান ধরে হয়তো ভাজতে পারবেন পনেরো থেকে ষোল মণ। কিন্তু চলমান লকডাউনের সময়ে ধানের দামের সঙ্গে মিল রেখে মুড়ির উৎপাদন খরচ তোলাই এখন ভাবার বিষয়।