ভার্চুয়াল বন্ধুদের মানবিক কল্যাণ অভিযাত্রা

‘প্রতিটি নতুন জিনিসকেই উৎকৃষ্ট মনে হয়। কিন্তু বন্ধুত্ব যতই পুরোনো হয়, ততই উৎকৃষ্ট ও দৃঢ় হয়’, এরিস্টটলের এই উক্তি ফেসবুক গ্রুপ ‘এসএসসি সারা বাংলা ৯১ ফাউন্ডেশন’-এর বন্ধুরা হৃদয়ে ধারণ করে। ১৯৯১ সালে যাঁরা এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলেন, এটি তাঁদেরই গ্রুপ এবং তাঁদেরই আখ্যান।
গ্রুপটির কার্যক্রম মাত্র তিন মাস আগে শুরু হলেও সমাজকল্যাণমূলক ও সমাজসেবায় বেশ কিছু অর্জন রয়েছে বলে গ্রুপের সদস্যরা জানান এনটিভি অনলাইনকে।
এই গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রতিষ্ঠান) কামরুল ইসলাম চৌধুরী। এনটিভি অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘মূলত ১৯৯১ সালে এসএসসি দেওয়া বন্ধুদের একটি ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্ম এসএসসি সারা বাংলা ৯১ ফাউন্ডেশন। আমরা চাই, আমাদের স্কুল বন্ধুদের মধ্যে যারা আর্থিকভাবে অসচ্ছল এবং অসুস্থতাজনিত কারণে সাহায্যের প্রয়োজন, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তাদের বিপদে পাশে দাঁড়ানো। ভবিষ্যতে আমাদের সন্তানদের জন্য শিক্ষাবৃত্তি চালু, সুস্থ ধারার সাংস্কৃতিক চর্চা অব্যাহত রাখা, ভার্চুয়াল লাইভের মাধ্যমে করোনাকালীন সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সর্বোপরি অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সুস্থ ও মননশীল মূল্যবোধসম্পন্ন আগামী বিনির্মাণে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার পারস্পরিক মতবিনিময় ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সামর্থ্যকে সমন্বিত করে বৃহৎ শক্তিতে পরিণত করা আমাদের লক্ষ্য। বন্ধুত্বের গণ্ডির বাইরেও প্রয়োজনে অসহায় আর্তমানবতার কল্যাণে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করা ফাউন্ডেশনের অন্যতম প্রধান কর্মপরিকল্পনা হিসেবে বিবেচিত।’

বাংলাদেশ নৌবাহিনীর কমান্ডার ফয়েজ ইসলাম বলেন, ‘অনলাইনে কাটানো সময়টুকু ভালো কাজ ও মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রত্যয় নিয়ে এ ফাউন্ডেশনের যাত্রা শুরু। মানবতার অগ্রদূত হিসেবে ফাউন্ডেশন যেসব কাজ ইতোমধ্যে করেছে, তার মধ্যে আছে অসুস্থ ও দরিদ্র সহপাঠীদের চিকিৎসা, কর্মহীন সহপাঠীদের কর্মসংস্থান, এতিম শিশুদের ইফতার, দরিদ্র শিশুদের ঈদের নতুন পোশাক বিতরণ, করোনায় অসুস্থদের হাসপাতালে বহন ও অক্সিজেন সেবা দেওয়া ইত্যাদি। মানবসেবামূলক কাজের পাশাপাশি ফাউন্ডেশনের সভ্যরা অনলাইন আলোচনা ও লাইভ সম্প্রচারের মাধ্যমে করোনা সচেতনতা, মানসিক ব্যাধি নিরাময়, নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্যসেবামূলক কার্যক্রমে অবদান রেখে চলেছে। বন্ধুদের মনোরঞ্জন ও বিনোদনের জন্য রমজানে হামদ ও নাত, ঈদ-পরবর্তী সময়ে লাইভ আড্ডা, আবৃত্তি ও সংগীতের অনুষ্ঠান করেছে। সন্তানদের সুস্থ বিনোদনে সম্পৃক্ত করতে শিশু-কিশোরদের নিয়েও লাইভ অনুষ্ঠান করেছে। ফাউন্ডেশনের এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুক, সেই শুভকামনা রইল।’
গ্রুপের সদস্য, ঢাকা মেডিকেল কলেজের সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আশরাফ খান এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘একদল ভালো মনের, পরোপকারী, নিঃস্বার্থ, কর্মপাগল বন্ধুদের নিয়ে এ ফাউন্ডেশনের যাত্রা। আমাদের মধ্যে অনেকেই আজ সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত। আবার আমাদের মাঝেই কিছু বন্ধু দুঃখ-দুর্দশায় রয়েছে। তাদের জন্য আমরাই সবার আগে এগিয়ে আসতে পারি।’

ট্রাস্ট আজিয়াটা ডিজিটাল লিমিটেডের কমার্শিয়াল ডিভিশনের ডিজিএম আহমেদ সুমন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘একে অপরের পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস, একে অপরের সুখ-দুঃখকে ভাগ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি নিয়েই এ ফাউন্ডেশনের যাত্রা। ফেসবুকের মতো ভার্চুয়াল মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে আমরা বাড়িয়ে দেব বন্ধুত্বের হাত। বন্ধুত্বের জয় হোক।’
গ্রুপের সদস্য, বাংলার হাটবাজারের কর্ণধার, উদ্যোক্তা শারমিন ইসলাম শুক্তি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য, দশের লাঠি একের বোঝা, একতাই বল, জীবে দয়া করে যে জন সে জন সেবিছে ঈশ্বর, কর্মই ধর্ম—এসব দীক্ষা ও শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়াই আমাদের লক্ষ্য ও উদেশ্য। আমরা কবির ভাষায় বলতে চাই—পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি এ জীবন মন সকলি দাও, তার মতো সুখ কোথাও কি আছে আপনার কথা ভুলিয়া যাও!’
ম্যাকসন্স স্পিনিং ও মেট্রো স্পিনিং-এর সিনিয়র ডিজিএম (মার্কেটিং) প্রদীপ কুমার সেন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমার কাছে বন্ধু মানে সাত রাজার ধন, আমার কাছে বন্ধু মানে মানিক রতন। এই বিশ্বাসকে সামনে রেখে এ ফাউন্ডেশনের জন্ম। জন্ম থেকেই ফাউন্ডেশন বন্ধুত্বের বন্ধনকে দৃঢ় করে, মানবতার সেবায় কাজ করে যাচ্ছে।’

গ্রুপের সদস্য, ব্যবসায়ী মোয়াজ্জেম হোসেন বিপুল বলেন, ‘আমাদের ভালোবাসার বন্ধনের শুরু, বন্ধুদের সঙ্গে বিচরণ, ১৯৮০-১৯৮১ প্রথম শ্রেণি থেকে এসএসসি ১৯৯১ সাল পর্যন্ত। প্রায় ৩০ বছর পেরিয়ে এসেছি; কিন্তু প্রায় সব বন্ধুদের সঙ্গেই আমার যোগাযোগ আছে। হয়তো জীবন-জীবিকার জন্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গিয়েছি সারা বাংলাদেশে। আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ৯১ ব্যাচ ছেলেবেলার বন্ধুদের মতোই সবার সঙ্গে আমার আত্মার সম্পর্ক গড়ে উঠল। মানবিক কাজ করার ইচ্ছাটা আল্লাহর রহমতে মনেই ছিল। আলহামদুলিল্লাহ, পেয়ে গেলাম কিছু ইউনিক মন-মানসিকতার উদার ও মানবিক বন্ধু। গত দুই বছর ধরে ৯১ ব্যাচের জন্য কাজ করে আসছিলাম। সেই কথা চিন্তা করেই গত তিন মাস আগে এসএসসি সারা বাংলা ৯১ ফাউন্ডেশন নামে ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মের যাত্রা শুরু হয়, মানবিক বন্ধুদের নিয়েই আর্তমানবতার সেবায় নিয়োজিত হয়ে আমাদের ফাউন্ডেশনের পথ চলা। সামনে এগিয়ে যেতে চাই বন্ধুদের নিয়ে আরও অনেকটা পথ।’
বিআইটির অর্থনীতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান এবং কবি, সাহিত্যিক ও কলামিস্ট সোমা তাহেরা চৌধুরী বলেন, ‘যদিও গ্রুপটির কার্যক্রম শুরু হয়েছে মাত্র তিন মাস হলো। বিগত তিন মাসে একানব্বইয়ের ঘূর্ণিঝড়ের মতোই প্রবল দাপট নিয়ে সমাজকল্যাণমূলক ও সমাজসেবায় মাইলফলক ছুঁয়েছে এসএসসি সারা বাংলা ৯১ ফাউন্ডেশন। একই শরীরের নানান অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মতোই এসএসসি ১৯৯১ ব্যাচমেটরা একে অপরের সুখে-দুঃখ এবং আনন্দ-বেদনায় সহযাত্রী। আমাদের মধ্য থেকে কেউ সফলতার শিখরে পৌঁছে গেছে, কেউ সফলতার প্রান্ত ছুঁয়েছে, আবার কেউ বা ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে পিছিয়ে রয়েছে। পিছিয়ে পড়া অসুস্থ ও অসহায় ব্যাচমেট ও তাদের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে কিছু আত্মনিবেদিত উদার প্রাণের একানব্বইয়ান, যারা এসএসসি সারা বাংলা ৯১ ফাউন্ডেশন গ্রুপের স্বেচ্ছাসেবী। শুধু তা-ই নয়, আর্তমানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে সমাজের অনগ্রসর ও অসহায় এতিম, দুস্থ এবং নিঃস্ব মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি এসএসসি সারা বাংলা ৯১ ফাউন্ডেশন গ্রুপের কুইক রেসপন্স টিমের সদস্যরা এবং আমরা নিরলস কাজ করে যাব ইনশা আল্লাহ।’
গ্রুপের সদস্য কবি সালমা জামান এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমাদের ফাউন্ডেশনের মূল উদ্দেশ্য হলো মানবতার সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করা, এই প্রত্যয় নিয়ে আমরা এগিয়ে যাব, ইনশা আল্লাহ।’

কিউএ গ্রুপের ডিজাইনিং ও মার্চেন্ডাইজিং বিভাগের ম্যানেজার বিপুল কুমার সাহা এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘গ্রুপের বন্ধুরা নিজেদের অবস্থান ও অবস্থা থেকে বন্ধুদের জন্য, বন্ধুদের পরিবারের জন্য, সর্বোপরি বন্ধুদের সন্তান—আমাদের উত্তরসূরিদের জন্য এমন কিছু করে যেতে চায়, যাতে তারা এই পৃথিবী থেকে চলে গেলেও তাদের পরিবার, স্বজন ও সন্তানেরা গর্ববোধ করে এই প্ল্যাটফর্মটির জন্য। তেমনই লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে এসএসসি সারা বাংলা ৯১ ফাউন্ডেশন।’
জনপ্রিয় বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এনটিভির অনুষ্ঠান বিভাগের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর চৌধুরী এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমি ৯১ ব্যাচের বন্ধু হতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি। ঋতুবৈচিত্র্যের এই দেশে বন্ধুত্বের সম্পর্কেও নানা টানাপোড়েন আসবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা বন্ধু। বন্ধু বন্ধুর পাশে থাকবে, মানবতার পাশে থাকবে, শুদ্ধতার পাশে থাকবে; এটাই কামনা।’
বন্ধুত্বের সুদৃঢ় বন্ধন অটুট রেখে মানবতার কল্যাণে ‘এসএসসি সারা বাংলা ৯১ ফাউন্ডেশন’ নিরলস কাজ করে যাবে, এ প্রত্যাশা সবার।