নারীরা পিছিয়ে আছে আত্মবিশ্বাসে : ডা. নুজহাত চৌধুরী
‘যোগ্য নারীকে কেউ ছোট করে রাখতে পারে না। তবে নারীরা পিছিয়ে আছে তাদের আত্মবিশ্বাসে। আর আত্মবিশ্বাসের এ ঘাটতি থাকার সুযোগকে ব্যবহার করছে আমাদের রক্ষণশীল সমাজ।’ কথাগুলো বলছিলেন অধ্যাপক ডা. নুজহাত চৌধুরী। ডা. নুজহাত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) চক্ষুবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। তিনি শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরীর মেয়ে।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে নারীর অগ্রগতিতে সমস্যা আর সম্ভাবনা নিয়ে এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেন ডা. নুজহাত। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন এনটিভি অনলাইনের স্টাফ করেসপনডেন্ট ফখরুল ইসলাম শাহীন।
এনটিভি অনলাইন : আন্তর্জাতিক নারী দিবস নিয়ে কী ভাবছেন?
ডা. নুজহাত চৌধুরী : কোনো ইস্যুকে সামনে নিয়ে আসার জন্যই দিবস পালন করি আমরা। তবে নারী দিবস পালন করা নিয়ে আমার একটা দ্বিধা আছে। আমার কাছে মনে হয়, বছরের ৩৬৫ দিনই মানুষের দিবস। তবে একটা বিশেষ দিবসকে সামনে এনে আমরা যদি গভীরভাবে চিন্তা করি, বা কথাগুলো সামনে আসে, তা মন্দও নয়। তবে আমি চাই একটি দিবসকে কেন্দ্র করে যদি সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলা যায় এবং সত্যি সত্যি যদি পরিবর্তন আসে, তাহলে মন্দ কী।

এনটিভি অনলাইন : স্বাধীনতার ৫০ বছরে নারীদের কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে বলে মনে করেন?
ডা. নুজহাত চৌধুরী : নারীদের আগ্রগতি অবশ্যই কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়েছে। যেমন ধরুন আমি আমার পেশা নিয়েই বলি, চক্ষু চিকিৎসা হলো একটা শল্য চিকিৎসা। এটা পুরোটাই সার্জারি লাইন। এ পেশায় ৫০ বছর আগে একজন নারীও ছিলেন না। আর এখন যদি আপনি আমার রেসিডেন্সির দিকে তাকান, বেশিরভাগ ক্লাসরুমে ৬০ শতাংশই মেয়ে। তবে আমরা এখনও মাইনরিটি, এখনও কম। তবে ১০ থেকে ১৫ বছর পর এটায় মেয়েদের ধারা নিয়ন্ত্রিত থাকবে। যেমন আগে শুনতাম, ‘তোমরা সার্জিকাল লাইনে যাচ্ছ, তোমাদের কাছে রোগীরা চশমা নেবে, কিন্তু অপারেশন নেবে না।’ কিন্তু, এখন আমার রোগীরা শুধু হাসপাতালেই নয়, আমার চেম্বারেও অপারেশন নিচ্ছেন, চিকিৎসা নিচ্ছেন। এখন আর রোগীরা নারী-পুরুষ বিবেচনা করেন না।
আবার কিছু ক্ষেত্রে দেখি, কিছু রক্ষনশীলতারও উত্থান হয়েছে। আমি মনে করি, যেকোনো মানবিক কথাবার্তা নারীদের মঙ্গলের জন্যই বলা হয়। সেটা ধর্ম হতে পারে, সেটা সমাজ হতে পারে। তবে কিছু সময় দেখা যায়, এগুলোকে ভুল ব্যখ্যা করে দমন-নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সেই বিষয়টার উত্থান কিন্তু আমরা আবার দেখছি। আবার আরেকটি বিষয়— ভালোর সঙ্গে সঙ্গে খারাপের একটা স্রোতও আছে। সেইসঙ্গে এটা অস্বীকার করলেও হবে না যে, নারীদের নিরাপত্তা আমরা এখনও নিশ্চিত করতে পারিনি। একদিকে আমরা যেমন নারীদের পুলিশ হিসেবে, প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে পাচ্ছি, সচিব হিসেবে পাচ্ছি, ডিসি হিসেবে পাচ্ছি, ডিশিসন মেকার হিসেবে কাজ করছেন, তাদের পাচ্ছি, সে রকম আবার ধর্ষণের বিষয়গুলোও সামনে আসছে। আমার মনে হয়, আমাদের অর্জন আছে, তবে এর পাশাপাশি আজকের এই ২০২১ সালে আমাদের যে চাওয়া, সে জায়গাটায় আমরা পৌঁছাতে পারিনি। নারী হিসেবে সেটা আমার মনে হয়।
এনটিভি অনলাইন : নারীর অগ্রগতিতে কী কী প্রতিবন্ধকতা আছে বলে আপনি মনে করেন?
ডা. নুজহাত চৌধুরী : প্রথম প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে আমাদের মানসিকতা এবং আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রের উদার নীতির অভাব। সেটা আমি সামগ্রিক অর্থে বলছি। এটা কোনো একটি ধারার শিক্ষার সিস্টেমকে যে বলছি বিষয়টা তেমন নয়, সামগ্রিক বিষয়েই। আমরা দেখি, নারীদের ক্ষেত্রে যে শ্রদ্ধার বিষয়টা, সেটা চলচ্চিত্রে হতে পারে, গান, নাটকসহ বিভিন্ন জায়গায় হতে পারে। পারিবারিক শিক্ষা—এগুলোর সব ক্ষেত্রে যে আমাদের ব্যবহারে উদারতার বা প্রগতিশীলতার হাইটটা থাকা দরকার, তা আমরা অর্জন করতে পারিনি। অনেক ক্ষেত্রে আমরা নারীদের বিজ্ঞাপনে দেখি, সিনেমায় দেখি যেভাবে করে উপস্থাপন করা হয়, ব্যক্তিগতভাবে এতে আমার ব্যাপক আপত্তি আছে। আমাদের দ্বিচারিতার ব্যাপার আছে। আমরা মা বলতে একেবারে অন্ধ, নিজের বোন বলতে একেবারে অন্ধ, (কিন্তু) আরেকজন নারী যে অন্য কারো মা, অন্য কারো বোন—সেটা আমরা ভাবছি না। আমি একটা কথা বলতে চাই—নারী-পুরুষ নয়, সব মানুষের মধ্যে সম্মানের জায়গাটা কমে যাচ্ছে। নারী ও শিশু র্নিযাতন কী পরিমাণে বেড়েছে! সমাজে পুরুষেরাই কি একেবারে ভালো আছে? আমি মনে করি, সমাজে নারী-পুরুষ বলে নয়, যিনি ক্ষমতাবান তিনিই শোষণ করার চেষ্টা করেন।
আমার বঙ্গবন্ধুর সেই কথাটি মনে হয়, পৃথিবী দুই ভাগে বিভক্ত—শোষক আর শোষিতদের মধ্যে। আমার মনে হয়, নারীরা শোষিতদের মধ্যেই বেশি থাকে। যে বিষয়টিতে আমার দুঃখ লাগে, তা হলো—নারী ও শিশুদের ক্ষেত্রে, যারা সমাজের স্পেশাল অংশ হওয়ার কথা ছিল, তাদেরই আমরা কম গুরুত্ব দিই বলে আমার মনে হয়।
এনটিভি অনলাইন : আপনার সফলতার গল্পটা শুনতে চাই
ডা. নুজহাত চৌধুরী : আমাদের নারীদের মধ্যে অনেকেই আছেন, যাঁরা বিভিন্ন বাধা অতিক্রম করে অনেক দূর এগিয়েছেন। আমার ক্ষেত্রে কিন্তু তার একটু ভিন্নতা রয়েছে। আমি যে পরিবার থেকে এসেছি এবং যে পরিবারে বিয়ে করেছি—দুটোই খুব প্রগতিশীল পরিবার। আমি বাধা তো পাই-নি, বরং উৎসাহ পেয়েছি। যেখানে আমি থেমে যেতে চেয়েছি, সেখানে উৎসাহ পেয়েছি। যেখানে আমি থেমে যেতে চেয়েছি, সেখানে আমার মা, স্বামীর জোরালো একটা ভূমিকা ছিল আমাকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য। তবে, সার্বিকভাবে বলতে গেলে সমাজ আমাদের ছাড় দেয় কম, আমরাও নিজেদের ছাড় দেই কম। নারীকে সমান প্রমাণ করার জন্য দ্বিগুণ পরিশ্রম করতে হয় এ সমাজে। এটা আসলে বৈষম্যমূলক। অনেক সময় মা নারী অফিসার, সবমিলিয়ে তাঁকে সুপারম্যান হতে হয়—সেটা আসলে সব সময় আশা করাটাও কঠিন। আমার কাছে মনে হয় যে, আমরা নারীরা নিজেদের ছাড় দেই কম। আমাদের সমাজও আমাদের ছাড় দেয় কম।
এনটিভি অনলাইন : সমাজে পিছিয়ে পড়া নারীদের জন্য আপনার বক্তব্য
ডা. নুজহাত চৌধুরী : আমি ঠিক পিছিয়ে পড়া বলব না, আমি বলব—নারীরা সমাজে চলার পথে বাধার সম্মুখীন হন। কারণ, সবাই তো এক রকম পরিবার থেকে আসে না, এক রকম অর্থনৈতিক ক্ষেত্র থেকে আসেন না। নারীদের মধ্যে যিনি বেশি অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল পরিবারের থেকে আসেন, তিনি শিক্ষায় ও অর্থনীতিতে যতটা দুর্বল থাকেন, সমাজ তাঁর জন্য ততটা কঠিন হয়। তাঁদের জন্য আমি বলব সংগ্রাম করতে, যুদ্ধ করতে, কখনোই আপস না করতে এবং তিনি যা চাইছেন, তার জন্য সৎ ভাবে যেটা প্রাপ্য, সেটার জন্য যুদ্ধ করতে। তবে আমি কখনও একজন নারীকে সমাজের বিরুদ্ধে যেতে বলি না।
আর একটা বিষয়, এটা শুধু নারীদের জন্যই নয়, আমি সব সময় বলি—বাধা আসবেই। মাঝে মধ্যে আমরা হারব, তবে হেরে যেন না যাই। আমরা পড়ে যাব, কিন্তু ভেঙে যেন না যাই। আমরা আবার উঠে দাঁড়াব, আত্মবিশ্বাসে বলিয়ান হয়ে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাব। জীবনে সফলতার সবচেয়ে বড় চাবিকাঠি হচ্ছে ছেড়ে না দেওয়া। আর আমি এসব নারীদের উদ্দেশে বলব, ঝগড়া না করে হাসিমুখে অনেক কিছু অর্জন করা সম্ভব। কোনো কিছু অর্জনের জন্য ঝগড়া করার প্রয়োজন হয় না।
এনটিভি অনলাইন : নারীরা কোথায় পিছিয়ে আছে বলে আপনি মনে করেন?
ডা. নুজহাত চৌধুরী : নারীরা পিছিয়ে আছে আত্মবিশ্বাসে। আর, আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি থাকার এই সুযোগটাকে আমাদের রক্ষণশীল সমাজ কাজে লাগায়। নারীকে মনে করতে হবে—আমি যে কারো সমকক্ষ। নারীকে দেখানোর চেষ্টা করতে হবে যে, আমি সবকিছু করতে পারি। এই বিশ্বাসটা রাখতে হবে। নারীকে যদি বলা হয়, তুমি পারবে না, তবে সেটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে আরও বেশি উদ্যমে ভুল প্রমাণ করার জন্য কাজ করতে হবে। আমার মনে হয়, এমন যুদ্ধভিত্তিক চিন্তাধারা সবার রাখতে হবে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব মানুষের ক্ষেত্রে এমন চিন্তাধারা থাকা উচিৎ।
সমালোচনাকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়ে, সত্যি যদি কোনো অক্ষমতা থাকে, কোনো অপূর্ণতা থাকে, সেটিকে আরও বেশি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে নিজের উন্নতি করতে হবে। এমন একটা পর্যায়ে যেতে হবে, যাতে স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে পারদর্শী হতে পারে। তখন নারীর দিকে আঙুল তুলে কথা বলার কেউ থাকবে না।
এনটিভি অনলাইন : নারীর স্বাধীনতা কোথায়?
ডা. নুজহাত চৌধুরী : নারীর স্বাধীনতা নিজের মনে, মাথায়, মানসিকতায়, অন্তরে। আমি তখনই পরাধীন, যখন আমি চিন্তা করব আমি পরাধীন। আমার যদি আত্মবিশ্বাস থাকে, কেউ আমাকে পরাধীন করতে পারবে না। হয়তো আমার সহযোগিতা লাগবে, তবে সহযোগিতা নেওয়া মানে কিন্তু পরাধীনতা নয়। পরাধীন কিন্তু কেউ নয়, যদি না সে নিজে সেই পরাধীনতার শেকল কাউকে পরানোর সুযোগ দেয়। সেই সুযোগ দেওয়া উচিৎ নয়।
স্রষ্টা ছাড়া কারও কাছে মাথা নোয়ানোর প্রয়োজন নেই। এই আত্মবিশ্বাস যদি নারীর থাকে, তাহলে পরাধীনতার কোনো সুযোগ নেই। যেটুকু বাধা সমাজ নারীর ওপর চাপিয়ে দেয়, সেটুকু অতিক্রম করার আত্মবিশ্বাসটা রাখতে হবে।
দুটো জিনিস নারীকে অর্জন করতে হবে। তা হলো—শিক্ষা ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। যে নারী অর্থনৈতিকভাবে আত্মনির্ভরশীল, সে নারীকে কেউ ছোট করে রাখতে পারে না। সেটার জন্য শিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধির প্রয়োজন আছে।