ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে পুরস্কারের ‘লোভ’, জেল-জরিমানার ভয়

যে ওয়ার্ডে ডেঙ্গু রোগী সব থেকে কম থাকবে সেই ওয়ার্ডের কাউন্সিলরকে পুরস্কৃত করা হবে বলে জানিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। পাশাপাশি বিভিন্ন স্থাপনায় থাকা এডিস মশার লার্ভার সন্ধান দিয়ে পুরস্কার পাবেন স্বেচ্ছাসেবকরাও।
আজ বুধবার রাজধানীর মোহাম্মদপুরে মশক নিধন অভিযানকালে এ ঘোষণা দেন ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম। এ সময় বাসাবাড়িতে লার্ভা পাওয়া গেলে তাদেরকে জরিমানার পাশাপাশি জেলের ভয়ও দেখান মেয়র।
করোনাভাইরাসের এই মহামারির মধ্যেই বর্ষাকালে রাজধানী ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রভাব দিন দিন বাড়ছে। গতকাল মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন অ্যান্ড কন্ট্রোল রুম থেকে ডেঙ্গু সংক্রান্ত প্রতিবেদনে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২৪ ঘণ্টায় দেশে ১৪৩ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ১৪২ জন রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মোট ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল ৫০৯ জনে। মোট রোগীর মধ্যে ৫০০ জনই রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। চলতি বছর ডেঙ্গুতে তিনজনের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করেছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)।
এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব নিয়ে জনগণকে সতর্ক করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, করোনার অতিমারির মধ্যে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বাড়তে থাকলে পরিস্থিতি ভয়ানক রূপ ধারণ করবে।
আজ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে পুরস্কারের কথা ঘোষণা করে মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘যে ওয়ার্ডে ডেঙ্গু রোগী সব থেকে কম থাকবে সেই কাউন্সিলরকে আমরা পুরস্কৃত করব। আমাদের ৭২০ জনের মতো স্বেচ্ছাসেবী আছেন। তারা বিভিন্ন স্থাপনায় গিয়ে ছবি তুলবেন। এভাবে যে স্বেচ্ছাসেবক এমন ছবি সব থেকে বেশি দিতে পারবেন যেখানে লার্ভা আছে, সেই স্বেচ্ছাসেবককেও আমরা পুরস্কৃত করব।’
বিশেষ করে কোনো নির্মাণাধীন ভবনে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেলে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না বলেও হুঁশিয়ারি দেন মেয়র। তিনি বলেন, ‘সেখানে জরিমানা করা হবে, প্রয়োজনে জেল দেওয়া হবে।’
ডেঙ্গু প্রতিরোধে প্রতি শনিবার সকাল ১০টায় ১০ মিনিটের জন্য পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কার্যক্রমের ঘোষণাও দেন আতিক। তিনি বলেন, আমরা একটা নতুন ক্যাম্পেইন করতে যাচ্ছি। এই ক্যাম্পেইনে প্রতি শনিবার সকাল ১০টায় ১০ মিনিটের জন্য নগরবাসী নিজ নিজ বাসাবাড়ি এবং এর আশেপাশের এলাকা পরিষ্কার করবেন।
ডিএনসিসির এই প্রচার অভিযানে আজ উপস্থিত ছিলেন জনপ্রিয় অভিনেতা মোশাররফ করিম। এ সময় তিনি ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনগণকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান।
অভিনেতা মোশাররফ করিম বলেন, “শহরটা শুধু আতিক ভাইয়ের একার না। আমাদের সবার। আমরা ‘আমি’ থেকে ‘আমরা’ হতে চাই। আমরা এমনিতেই করোনার ঝামেলায় আছি। তার মধ্যে এই অভিযান আমাদের সবার নিরাপত্তার জন্যই। আমরা যাতে সুস্থ থাকি তার জন্যই এই প্রচার। এই শহরের ভালোর জন্য।”
অভিযানে ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জবাইদুর রহমান, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজাসহ সিটি করপোরেশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
পরে মেয়র আতিকের নেতৃত্বে মোটর শোভাযাত্রা বের করা হয়।
গতকাল মঙ্গলবার থেকে নিজেদের ৫৪টি এলাকায় মশক নিধনে বিশেষ চিরুনি অভিযান শুরু করেছে ডিএনসিসি। প্রায় পাঁচ হাজারের বেশি কর্মী থাকবে ১০ দিনব্যাপী এই অভিযানে।
ডেঙ্গু জ্বর
ডেঙ্গু জ্বরের উৎপত্তি ডেঙ্গু ভাইরাস দ্বারা এবং এই ভাইরাসবাহিত এডিস ইজিপটাই নামক মশার কামড়ে। স্বল্প ক্ষেত্রে অসুখটি প্রাণঘাতী ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে পরিণত হয়। যার ফলে রক্তপাত, রক্ত অনুচক্রিকার কম মাত্রা এবং রক্ত প্লাজমার নিঃসরণ অথবা ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে রূপ নেয়। যেখানে রক্তচাপ বিপজ্জনক মাত্রায় কম থাকে।
ডেঙ্গু ছড়ায় এডিস মশার কারণে। ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশা কোনো ব্যক্তিকে কামড়ালে সেই ব্যক্তি চার থেকে ছয় দিনের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন। এবার এ আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোনো জীবাণুবিহীন এডিস মশা কামড়ালে সেই মশাটিও ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশায় পরিণত হয়। এভাবে একজন থেকে অন্যজনে মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়িয়ে থাকে।
ডেঙ্গুতে সাধারণত তীব্র জ্বর এবং সেই সঙ্গে শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। জ্বর ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়। শরীরে বিশেষ করে হাড়, কোমর, পিঠসহ অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশিতে তীব্র ব্যথা হয়। এ ছাড়া মাথাব্যথা ও চোখের পেছনে ব্যথা হয়। গায়ে রেশ হতে পারে। এর সঙ্গে বমি বমি ভাব হতে পারে।
ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধ
ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধের মূল মন্ত্রই হল এডিস মশার বিস্তার রোধ এবং এই মশা যেন কামড়াতে না পারে, তার ব্যবস্থা করা। বাড়ির আশপাশের ঝোপঝাড়, জঙ্গল, জলাশয় ইত্যাদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। যেহেতু এডিস মশা মূলত এমন বস্তুর মধ্যে ডিম পাড়ে যেখানে স্বচ্ছ পানি জমে থাকে, তাই ফুলদানি, ডাবের খোসা, পরিত্যক্ত টায়ার ইত্যাদি সরিয়ে ফেলতে হবে। ব্যবহৃত জিনিস যেমন মুখ খোলা পানির ট্যাংক, ফুলের টব ইত্যাদিতে যেন পানি জমে না থাকে, সে ব্যবস্থা করতে হবে।
এডিস মশা সাধারণত সকাল ও সন্ধ্যায় কামড়ায়। তবে অন্য সময়ও কামড়াতে পারে। তাই দিনে ঘরের চারদিকে দরজা জানালায় নেট লাগাতে হবে। দিনে ঘুমালে মশারি টাঙিয়ে অথবা কয়েল জ্বালিয়ে ঘুমাতে হবে।