করোনায় মানবিকতার হাত বাড়ালেন যাঁরা

‘মানুষ মানুষের জন্যে, জীবন জীবনের জন্যে, একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না; ও বন্ধু…’, বিখ্যাত সংগীতশিল্পী ভূপেন হাজারিকার এ গানের কথাগুলো করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও কেউ কেউ বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করেছেন। সংকটকালে অসহায় মানুষের খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন, চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তাঁরা সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন, সবার ওপরেই মানবতা।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী প্রথম শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ। মহামারি করোনাভাইরাস সেদিন দেশে নতুন উদ্বেগ ও আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। তত দিনে সারা পৃথিবী কাঁপছিল করোনা আতঙ্কে। করোনা নামের এই সংক্রামক ভাইরাসটি এক ভয়ংকর রূপে আবির্ভূত হয় বিশ্বজুড়ে। সেই আতঙ্কে আতঙ্কিত হয়ে ওঠে পুরো বাংলাদেশ। দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে ৭০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয় চলতি বছরের ১৮ মার্চে। এরপর দিনের পর দিন দেশে করোনাভাইরাসে শনাক্ত রোগী ও মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।
করোনা সংক্রমণ কমাতে সরকার বাধ্য হয়ে সারা দেশে লকডাউন ঘোষণা করে। একে একে স্কুল-কলেজ, দোকানপাট, কলকারখানা, গণপরিবহণসহ সব কিছু বন্ধ হতে শুরু করে। এতে পুরো পৃথিবীর মতো হুমকির মুখে পড়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিও।
স্থবির সেই সময়ে কর্মহীন হয়ে পড়েন অনেকেই। পড়েন খাদ্য সংকটে। ঘরবন্দি সাধারণ মানুষও পড়ে খাদ্য সংকটে। সব মিলিয়ে তাদের বিপদের শেষ ছিল না। আর তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন কিছু মানুষ। দিয়েছিলেন খাদ্যের জোগান। দিয়েছিলেন চিকিৎসাসেবা। মানবতার পাশে দাঁড়ানো এসব মানুষের মধ্যে কয়েকজন পেয়েছেন জাতিসংঘের ‘রিয়েল লাইফ হিরো’ স্বীকৃতি।

ক্ষুধার্তদের খাদ্যদান
২০২০ সালের ২৬ মার্চ। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সারা দেশ লকডাউন করে দেয় সরকার। কাজ হারিয়ে বিপাকে পড়ে সাধারণ মানুষ। সেদিন থেকে সাধারণ মানুষের কাছে ‘হটলাইন’ খুলে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি কামরুল হাসান রিপন। তিনি প্রায় ৩০ হাজার প্যাকেট খাদ্য সহায়তা দেন মানুষের মধ্যে। প্যাকেটের মধ্যে মধ্যে ছিল চাল, ডাল, তেল, লবণ, আলু, সাবান, হ্যান্ড স্যানিটাইজারসহ করোনা প্রতিরোধক সামগ্রী।

মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে লাশ দাফন
করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে মারা যান নারায়ণগঞ্জের ৭৫ বছর বয়সী হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক কৈলাস বণিক। করোনা আতঙ্কে সে সময় পাড়া-প্রতিবেশীসহ কেউ এগিয়ে আসেননি লাশের কাছে। ছেলে বাবাকে সৎকার করানোর আকুতি নিয়ে চাচাতো ভাইদের কাছে গেলেও তাঁরা এগিয়ে আসেননি। এই খবর পৌঁছে যায় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও মহানগর যুবদলের সভাপতি মাকছুদুল আলম খোন্দকার খোরশেদের কাছে। তারপর ছুটে গিয়ে সেই লাশ সৎকার করেন তিনি। তারপর থেকে তিনি নিয়মিত করোনায় আক্রান্ত হয়ে বা করোনার উপসর্গ নিয়ে মৃত ব্যক্তিদের লাশ দাফন বা সৎকার করতেন। এই কাজ করতে গিয়ে খোরশেদ ও তাঁর স্ত্রী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন। করোনা থেকে সুস্থ্য হওয়ার পরও তাঁর কাজ অব্যাহত রেখেছেন। মানবিক মানুষ খোরশেদ এ পর্যন্ত ১৪৫টি লাশ দাফন বা সৎকার করেছেন।

অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টান্ত স্থাপন
করোনা সংকটে অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন ছাত্রলীগের উপসাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক তিলোত্তমা সিকদার। করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই মুসলমানদের মাহে রমজান শুরু হয়। সে সময় খাদ্যসংকটে কর্মহীন থাকা সাধারণ মানুষদের রোজা রাখতে ও ইফতার করতে কষ্ট হচ্ছিল। তখন নিজ হাতে ইফতার বানিয়ে বরিশাল শহরের বিভিন্ন জায়গায় বিতরণ করতেন তিলোত্তমা। এমনকি বৃষ্টিতে ভিজেও ইফতার বিতরণ করে গেছেন তিনি। তিলোত্তমা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী।

টানা ১২১ দিন খাদ্য সহায়তা
করোনা পরিস্থিতিতে যখন মানুষের আয়-রোজগার অনেকটা বন্ধ হয়ে যায়, তখন সেই সব মানুষকে দুই বেলা খাবার তুলে দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) তৎকালীন সদস্য ও ছাত্রলীগ নেতা তানভীর হাসান সৈকত। টানা ১২১ দিন তিনি খাদ্য সহায়তা দেন সাধারণ মানুষ, ভ্রাম্যমাণ ছিন্নমূল ও ভিক্ষুকদের। তাঁদের সঙ্গেই পুরো রমজানসহ ঈদও উদযাপন করেছিলেন সৈকত। শুধু তাই নয়, ওই সময়কার বন্যা পরিস্থিতিতেও তিনি উত্তরাঞ্চলের বন্যা কবলিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। করেছিলেন খাদ্য সহায়তা।

জয় বাংলা অক্সিজেন সেবা
মার্চে করোনা সংক্রমণ শুরু হয়। এরপর যখন ধীরে ধীরে রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে তখন দেখা দেয় অক্সিজেন সিলিন্ডারের সংকট। এর অভাবে অনেক মানুষ মারা যায়। ঠিক সেই মুহূর্তে মুমূর্ষু রোগীদের সেবায় বিনামূল্যে অক্সিজেনসেবা নিয়ে আসেন ছাত্রলীগের তিন নেতা। তাঁরা এ সেবার নাম দেন ‘জয় বাংলা অক্সিজেন সেবা। এই তিন উদ্যোক্তা হলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সাদ বিন কাদের চৌধুরী (সাদী), উপবিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক সবুর খান কলিন্স ও ঢাবি শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম সবুজ।