দেবেশ রায়
সাহিত্যের অনন্য ভাষ্যকার

‘আমার কোনো সিদ্ধান্ত নেই। আমি শুধু একজন ঔপন্যাসিকের শিল্প সংকটের কথা ভাবছি- এমন কোনো ঔপন্যাসিক যে আজ বা আগামীকাল উপন্যাসের এমন এক ভাষার অধিকার চাইতে পারে যে-ভাষায় তার কথা সত্য মনে হবে, বানানো মনে হবে না। আমি এমন একজন ঔপন্যাসিকের শিল্পসংকটের কথা ভাবছি, যে আজ বা আগামীকাল চাইতে পারে সে যে-বাক্যটি রচনা করবে আর সেই বাক্যের ভেতরে যে-অর্থটি ভরে দিতে চাইবে, তার মাঝখানে একমাত্র সংযোজক হিসেবে সে-ই থাকবে লেখক হিসেবে, কথক হিসেবে; যে কোনো কলোনির প্রজা হিসেবে কলোনির কোনো শিক্ষা তার বাক্যের ভেতরে ভরে দেবে না। আমি এমন একজন ঔপন্যাসিকের কথা ভাবছি যে আজ বা আগামীকাল চাইতে পারে- সে স্বাধীন, তার লেখা স্বাধীন ও সেই লেখায় নিহিত অর্থ স্বাধীন।’ কথাগুলো দেবেশ রায়ের।
১৯৪৭ সালের দেশভাগ আরো বহু কিছুর মতো দ্বিখণ্ড করেছিল বাঙালির সাহিত্যকেও। বাঙালির ইতিহাস নতুন পথে বাঁক নেওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের বাংলা কথাসাহিত্যের ভার যাঁরা হাতে তুলে নিয়েছিলেন, দেবেশ রায় ছিলেন সেই নবীনদের দলে। নবীনদের মধ্যে তিনি ছিলেন বটে, তবে ঠিক দলের ছিলেন না— না ভাবনায়, না লেখায়, না সাহিত্যে তাঁর অনুসন্ধানে। ক্রমশ পাকা হয়ে ওঠা কথাসাহিত্যের রাজপথ ছেড়ে আস্তে আস্তে তিনি সরে আসেন নিজের গড়ে তোলা এক আলপথে। হয়ে ওঠেন বিশিষ্ট।
১৯৩৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর পাবনা জেলার বাগমারা গ্রামে দেবেশ রায়ের জন্ম। তাঁর শৈশবের কয়েকটি বছর কাটে উত্তাল যমুনার পারে। দেশভাগের কিছু আগে, ১৯৪৩ সালে, তিনি তাঁর পরিবারের সঙ্গে পূর্ববঙ্গ ছেড়ে চলে যান জলপাইগুড়িতে।
যযাতি দিয়ে দেবেশ রায়ের উপন্যাসের সূচনা। কিন্তু ভারতের রাজনীতি যখন নকশালবাড়ি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থায় টালমাটাল, তখন বাংলা সাহিত্যে তাঁর নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চারের সূচনা ঘটে, ১৯৭০-এর দশকে। মানুষ খুন করে কেন, মফস্বলী বৃত্তান্ত, সময়-অসময়ের বৃত্তান্ত— একের পর এক উপন্যাসের অফুরন্ত প্রবাহ তাঁর শৈশবের নদী যমুনার মতো পাঠকের অভিজ্ঞতা ভেঙেচুরে একাকার করে দেয়। এ অভিজ্ঞতা তুঙ্গে পৌঁছায় তাঁর তিস্তাপাড়ের বৃত্তান্তে। রূপায়িত ইতিহাস আর মানুষের অচরিতার্থ স্বপ্নের চিরন্তন দ্বন্দ্বের এক মনুষ্যপ্রতিমা তাঁর এ উপন্যাসের চরিত্র বাঘারু। উপন্যাসটির জন্য তিনি ১৯৯০ সালে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারে সম্মানিত হন।
বাংলা ভাষা ও কথাসাহিত্য নিয়ে বহু মৌলিক প্রস্তাবও দেবেশ রায় তুলেছেন তাঁর উপন্যাস নিয়ে, উপন্যাসের নতুন ধরনের খোঁজে, উপনিবেশের সমাজ ও বাংলা সাংবাদিক গদ্য বইগুলোতে। বাংলা সাহিত্যে উপনিবেশের প্রভাব ও বাংলা ভাষার নিজস্ব প্রতিভা তাঁর অনুসন্ধানের বিষয়। ১৯৮০-র দশকের শুরু থেকে তিনি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত প্রতিষ্ঠিত ‘পরিচয়’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।
‘উপন্যাসের ফর্ম বা মডেল বলব কাকে? ঔপন্যাসিকের অভিজ্ঞতা বা জ্ঞানকে যা উপন্যাসে পরিণত করে সেটাই তো ফর্ম। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে গল্প-উপন্যাস লেখার নানা চেষ্টায় বারবার হয়তো এখানেই ঠেকে গেছি। ঠেকে যে গেছি তাও হয়তো বুঝিনি, বুঝি না। এখন যখন নিজের অতীতটাকে একসঙ্গে দেখার মতো চড়াইয়ের দিকে চলছি আর সেই চড়াই থেকে যতই চোখের সামনে বাংলা উপন্যাসের সমতল বিস্তৃততর হচ্ছে, ততই অসহায় ও ক্ষমতাহীন ক্ষোভে বুঝতে পারছি, ইউরোপীয় মডেলে আমাদের পরিত্রাণ নেই।’ (উপন্যাসের নতুন ধরনের খোঁজে, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০০৬, পৃ ২০-২১)
‘বাংলাদেশের গল্প-উপন্যাসের নানারূপতা ও বিবিধ মাহাত্ত্ব আমাকে মুগ্ধ করে।’ বলেন দেবেশ রায়, ‘সে-মুগ্ধতা ঐ ভাষার গল্প-উপন্যাসের ফলবান ভবিষ্যতের আশানির্ভর কিছু নয়, যা লেখা হয়েছে ও হচ্ছে সেই চোখের সামনে বর্তমান-নির্ভর।’ বাংলাদেশ নিয়ে তাঁর উপলব্ধির সামান্য আভাস পাওয়া যাবে ‘বাংলাদেশের নাটক নভেল : কিছু আনাড়ি আন্দাজ’ বইটিতে। সেসব আন্দাজ নিয়ে জোর তর্ক চলবে, তবে সেগুলো এড়িয়ে যাওয়া কঠিন হবে।
দেবেশ রায়ের মননচর্চার ব্যাপ্তি ও দীপ্তি, শাণিত যুক্তি দিয়ে শাণিত গদ্যে বক্তব্য উপস্থাপনরীতি, চিন্তার স্বাবলম্বন, বিষয়ের বৈচিত্র্য বাংলা মননশীল গদ্যের মূল্যবান সংযোজন হিসেবেই পাঠ্য –এ কথায় কোনো দ্বিধা নেই। তাঁর মননচর্চায় উপন্যাস নিয়ে ভাবনা এক বিশেষ দিক। প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত পাশ্চাত্য মডেল বা ফর্মকে প্রত্যাখ্যান করে বাঙালির নিজস্ব মডেলে বা ফর্মে বাংলা উপন্যাসের ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা থেকেই দেবেশ রায় নতুন ধরনের উপন্যাসের খোঁজ করেন। ‘নির্বিকল্প অতীত’ নয়, ‘বহুবিকল্প অতীত’কে অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে সিনেমার পর্দা ওঠানোর মতো একে একে বিস্ময়, বিতর্ক, যুক্তি ও তর্কের পর্দা সরিয়ে সামনে এগিয়ে যায় দেবেশ রায়ের নতুন ধরনের উপন্যাস খোঁজার মিশন। এই মিশন অবশ্যই বর্তমান সময় পরিপ্রেক্ষিতকে সামনে রেখে। নতুন ধরনের উপন্যাস খোঁজার মিশনে বেরিয়ে কোথাও যুক্তিরহিত আবেগ দ্বারা পরাস্ত হননি দেবেশ রায়। নিজের মধ্যে কোনো ধরনের আবরণ রাখেননি অথবা সম্মোহন জাগিয়ে রাখেননি। সোয়াশো বছরের নির্মিত বাংলা উপন্যাসের অপুষ্ট শরীরের কোনো একটি জায়গাও অক্ষত রাখেননি। দক্ষ শল্য চিকিৎসকের মতো বাংলা উপন্যাসকে ব্যবচ্ছেদ করে প্রায় নির্বিকারভাবে তিনি চিহ্নিত করে গেছেন, কোথায় কোথায় এবং কী কী কারণে বাংলা উপন্যাসের নিজস্ব ঐতিহ্য বা মডেল তৈরি হয়নি, এই কাজে তিনি প্রথাগত সাহিত্যের ইতিহাস লেখার ঐতিহ্য থেকে বেরিয়ে এসে সম্পূর্ণ নিজস্ব একটি যুক্তিসৌধ নির্মাণ করেন।
প্রথম গল্প ও গল্পগ্রন্থ নিয়ে দেবেশ রায়ের স্মৃতিকথা দিয়ে লেখাটি শেষ করা যাক-
“দেশ-এ আমার গল্প পরের সংখ্যায় বেরবে, এই খবর দিয়ে সাগরময় ঘোষের খাড়া অক্ষরে লেখা একটা পোস্টকার্ড বৃষ্টিভেজা সাত-সকালে আমার ছোটভাই সমরেশ সাইকেল চালিয়ে যখন আমাদের আনন্দ চন্দ্র কলেজে (জলপাইগুড়ি) পৌঁছে দিল, তখন আমি কলেজের ছাদের ওপর একটা ত্রিপলের দড়ি টানাটানি করছি বন্ধুদের সঙ্গে। দিনটা ছিল ২ সেপ্টেম্বর— আমাদের কলেজের প্রতিষ্ঠা দিবস। আমি কলেজ ইউনিয়নের মাতব্বর। ঠিক করেছি, কলেজের মাঠেই অনুষ্ঠান হবে। সেই সব কাজে রাতে কলেজেই ছিলাম সবাই মিলে। শেষ রাত থেকে বৃষ্টি। তাই সকালে বাড়তি কাজ— ত্রিপল টাঙানো। পরের সপ্তাহের দেশ-এ বেরিয়েছিল ‘হাড়কাটা’, ১৯৫৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর। আমার বয়স তখন উনিশ। তখনকার থার্ড ইয়ারে পড়ি।
“এর বছর পনেরো পরে, জলপাইগুড়ির ডাকোটা প্লেন সার্ভিসের অফিস থেকে আমার একটা পার্সেল এসেছে ফোন পেয়ে সমরেশই, সেই সাইকেল করেই, পার্সেলটা আনতে গিয়ে দেখল সাইকেলে আনার পক্ষে ওটা একটু বড় ও ভারী। সুতরাং রিকশাই নিতে হলো। বাড়িতে পার্সেল খুলে দেখল আমার প্রথম বই, ‘দেবেশ রায়ের গল্প’। আমি বাড়িতে ছিলাম না। তখন, ১৯৬৯ সালে, আমি ওই কলেজেই বছর দশেক পড়াচ্ছি, রাজনীতি করছি প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা। যুক্তফ্রন্টের নেতা। বাবা নেই, আমার পিতৃতুল্য অধ্যাপক অমূল্যচন্দ্র মিত্র নেই। তাঁদের দুজনকেই উৎসর্গ করেছিলাম বইটি। দাদা আন্দামানে, ভারত সরকারের চাকরিতে। দিদিদের ও বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। আমারও। কাকলি শান্তিনিকেতনের সংগীতভবনে। ১৯৬৮-র অক্টোবরে জলপাইগুড়ির প্রলয়বন্যা হয়ে গিয়েছে। তখনো আমরা ফ্রি রেশন পাচ্ছি। আমার প্রথম বই বলতে এটাই। শুধু প্রথম বই-ই নয়, অনেক দিন পর্যন্ত এটাই ছিল আমার একমাত্র বই। বয়স তখন তেত্রিশ।
“প্রথম গল্প বেরোবার প্রায় পনেরো বছর পর, আটটি মাত্র গল্প নিয়ে অবশেষে আমার প্রথম বই বেরল কেন? এই পনেরো বছর পত্রপত্রিকায় গোটা উপন্যাস, ধারাবাহিক উপন্যাস, গল্পের পর গল্প অনবরত বেরিয়ে গেছে— ‘পরিচয়’, ‘এক্ষণ’, ‘দেশ’ ইত্যাদি আরো সব বিখ্যাত, বাণিজ্যিক, অবাণিজ্যিক কাগজে। তার ভেতর কিছু গল্প নিয়ে তর্কবিতর্ক হয়েছে, ছোটগল্পের নামকরণ, ধরনধারণ, আকারপ্রকার নিয়ে দশ কথাও হয়েছে। ‘ছোটগল্প : নতুন রীতি’ বলে একটা আওয়াজও উঠেছে, ‘যযাতি’ বেরিয়েছে, ‘আপাতত শান্তিকল্যাণ হয়ে আছে’, হয়তো ‘মফস্বলি বৃত্তান্ত’-এর দু-এক টুকরোও বেরিয়েছে, প্রবন্ধ, সমালোচনাও। মানে আমি দস্তুরমতো লেখক এই পনেরো বছর ধরে, স্বাধিকারেই, সৌজন্যবশত নয়। কিন্তু বই বোরোয়নি।”