বিনয়ের কবিতা পাঠ
কেন যেন স'রে যাও

কেন যেন সরে যাও, রৌদ্র থেকে তাপ থেকে দূরে।
ভেঙে যেতে ভয় পাও; জাগতিক সফলতা নয়,
শয়নভঙ্গীর মতো অনাড়ষ্ট স্বকীয় বিকাশ
সকল মানুষ চায়- এই সাধনায় লিপ্ত হতে
অভ্যন্তরে ঘ্রাণ নাও, অযুত শতাব্দীব্যাপী চেয়ে
মস্তিষ্কে সামান্যতম সাধ নিয়ে ক্লিষ্ট প্রজাপতি
পাখাময় রেখাচিত্র যে নিয়মে ফুটিয়ে তুলেছে
সে নিয়ম মনে রাখো; ঢেউয়ের মতন খুঁজে ফেরো।
অথবা বিম্বের মতো ডুবে থাকো সম্মুখীন মনে।
এমন কি নিজে নিজে খুলে যাও ঝিনুকের মতো,
ব্যর্থ হও, তবু বালি, ভিতরে প্রবিষ্ট বালিটুকু
ক্রমে ক্রমে মুক্তা হয়ে গতির সার্থক কীর্তি হবে।
শয়নভঙ্গীর মতো স্বাভাবিক সহজ জীবন
পেতে হলে ঘ্রাণ নাও, হৃদয়ের অন্তর্গত ঘ্রাণ।
(কেন যেন স’রে যাও, বিনয় মজুমদারের শ্রেষ্ঠ কবিতা, ১৯৮৯)
ফরাসি কবি পল ভালেরি বলেছেন, ‘কবিতার প্রথম চরণটি বিনা কারণে দেবতারাই আমাদের দেন।’ এটা খুব সুন্দর বাজে কথা, মূলত এর মধ্য দিয়ে কবিদের দরবেশিপনা বা অতিন্দ্রিয় ক্ষমতার বাহাদুরি দেখানো হয়েছে। প্রতীকবাদীরা তাই করতেন; অনেক কবি প্রকৃতির বিরুদ্ধে তো বটেই, বিজ্ঞানের বিরুদ্ধেও অবস্থান নিয়েছিলেন; কিন্তু অতিন্দ্রিয় বলে কিছু নেই, অন্তত আধুনিক কবির কাছে তা থাকতে নেই। প্রতীকবাদী কেন, কোনো কবিতার কোনো চরণই দেবতাদের উপহার নয়, যদিও সেটি ভেবে পুলক বোধ করেছেন বহু কবি এবং নিজেদের বুদ্ধিকে হাস্যকর করে তুলেছেন। প্রশ্ন উঠবে হয়তো, তা হলে কবিতার প্রথম চরণটি আসে কোত্থেকে? এ ধরনের প্রশ্ন অবশ্য শিশুরাই করে থাকে, তাদের প্রতি জবাব হতে পারে : কবিতার সব চরণই আসে অনুভব প্রকাশের কাব্যিক চাপ বা ইচ্ছে থেকে; শিল্পকলার অন্তর্গত প্রতিটি উচ্চারণ এক ধরনের আকস্মিকতার জন্ম দেয়, ফলে, মনে হয়, সবার পক্ষে এমনটি সম্ভব নয়। কিন্তু সোস্যুরই বলেছেন, ভাষা একটা আকস্মিকতা থেকে অভিপ্রায়ের দিকে যায়।
এসব অন্য বিতর্ক। ‘কেন যেন সরে যাও রৌদ্র থেকে তাপ থেকে দূরে’- কাকে উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছে? কবিতায় তার সাক্ষাৎ পাওয়ার উপায় নেই; সে-আশা করাও ঠিক নয়। কিন্তু কবিতার শুরুতে করা এই প্রশ্ন প্রত্যুত্তরের মতোই শোনাচ্ছে। এটা স্পষ্ট হয়ে যায় এর পরেই, যখন আমরা পড়ি- ‘ভেঙে যেতে ভয় পাও’। এই হেঁয়ালি থেকে যে পঠনসক্রিয়তা তৈরি হচ্ছে তাতেই আমাদের আপাতত সন্তুষ্ট থাকতে হবে। শুরুতে গৌরব বোধ করলেও প্রতীকবাদের বিকাশ ও বিকৃতির পর এর অনুসারী কবিরা ‘হেঁয়ালি’ শব্দটায় কষ্ট পান; তাঁরা একে বলেন, ‘আবেশ’, ‘বর্হিরেখা’, ‘রহস্যে প্রবেশের দরজা’, ‘ইঙ্গিতের বাহন’ ইত্যাদি। মালার্মে অবশ্য হেঁয়ালিকেই কবিতার বাহাদুরি হিসেবে বিবেচনা করেছেন; কবিতার আবশ্যকীয় শর্ত ও ‘সাহিত্যের লক্ষ্য’ বলে জানিয়েছেন। যা-ই হোক, ‘রৌদ্র’ আর ‘তাপ থেকে’ যে ‘দূরে’ ‘সরে’ যায়, সে ‘ভেঙে যেতে ভয়’ পায়; তাকে ‘শয়নভঙ্গীর মতো স্বাভাবিক সহজ জীবন’ পেতে প্রলুব্ধ করা হচ্ছে এবং সেজন্য কী করতে হবে, তা বলে দেওয়া হচ্ছে; সঙ্গে বিকল্পও দেখিয়ে দেওয়া হচ্ছে চিত্ররূপের সাহায্যে।
বেলজীয় কবি ও সমালোচক আলবের মকেল (১৮৬৬-১৯৪৫) লিখেছেন, বস্তুর মধ্যে অসীমের প্রতিচ্ছবি খুঁজে, বস্তুকে দিয়ে জোর করে অসীমের প্রকাশ ঘটিয়ে মানুষ নিজের মধ্যেই তার অভিজ্ঞান আবিষ্কার করে। আরো বলেছেন, ‘প্রতীক হচ্ছে একটি বৃহৎ চিত্রকল্প, কোনো ভাবকে অবলম্বন করে এটি বিকশিত হয় এবং যার সুগন্ধ শিল্পকর্মের প্রতিটি রেখায় তরঙ্গিত হয়ে ওঠে।’ আলোচ্য কবিতায় একটি চিত্রকল্প দিয়ে বিনয় মজুমদার প্রকাশ করেছেন ভাব, যার কেন্দ্র হচ্ছে ‘স্বাভাবিক সহজ জীবন’ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ও উপায়। কিন্তু শুরুটা এমন হেঁয়ালি দিয়ে করেছেন, বোধগম্যতার চাবিটি কোনো সক্রিয়তা ছাড়া পাঠকের হাতে দিতে তিনি রাজি নন। মালার্মে শ্রমবিমুখ পাঠকদের বিদ্রূপ করে লিখেছিলেন, ‘প্রথম দৃষ্টিতে আকৃষ্ট হওয়ার মতো কিছু না পেয়ে পুলকিত হয়ে ওঠে এমন নিষ্কর্মা পাঠককে ফিরিয়ে দিলে ক্ষতি নেই, বরং লাভ।’ কিন্তু বিনয় মজুমদার বোধগম্যতার চাবিটি শেষ পর্যন্ত পাঠকের হাতে তুলে দিয়েছেন। ফলে, মজার ব্যাপার হলো, হেঁয়ালি থাকলেও কবিতাটি অস্পষ্ট নয়, যেমনটি প্রতীকবাদী কবিতা হয়ে থাকে।
অস্পষ্ট নয়, কারণ, মালার্মের রচনাপদ্ধতির কেবল একটি শর্ত এতে মানা হয়নি বা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। তা হলো : শব্দের প্রার্থিত বিকল্প সন্ধান। আর্থার সাইমন্স, যিনি ইংরেজি সাহিত্যের সঙ্গে ফরাসি প্রতীকবাদের সফল ঘটকালিটি করেছিলেন, তাঁর মতে, পাঠকের হতবুদ্ধি হয়ে পড়ার জন্যে এই বিকল্পের অনুশীলনই যথেষ্ট। কেননা, ভাব প্রকাশে অনিবার্য শব্দের প্রাথমিক প্রয়োগ বাদ দিয়ে কবি সেসবের কাম্য বিকল্প নির্বাচনে যখন ব্যস্ত হয়ে পড়েন, তখনই কবিতাটি প্রতিপাদ্য থেকে দূরে সরে যায় এবং সূচনাবিন্দুটি যাত্রাপথে সঙ্গতি হারিয়ে কবিতাপাঠের অভিজ্ঞতাকেই অপ্রীতিকর করে তোলে। বিনয় মজুমদার শব্দের প্রার্থিত বিকল্প খোঁজেন নি; তিনি সেই কাজটি করেছেন ক্রিয়া-উপমায় : ‘ঢেউয়ের মতোন খুঁজে ফেরো’, ‘বিম্বের মতো ডুবে থাকো’, ‘খুলে যাও ঝিনুকের মতো’ ইত্যাদি। কিন্তু পরামর্শের ভঙ্গি, আবর্তনধর্মী ন্যারেশন, নকশা, সংবৃত সমাপ্তি এইসব মিলে কবিতাটি হয়ে উঠেছে প্রতীকবাদের শুরুর দিককার, মানে একশ বছরেরও বেশি আগের রচনা। তাতে সমস্যা নেই। ইউরোপে রোম্যান্টিক কবিরা যখন মরে ভূত হয়ে গেছেন, তখন রবীন্দ্রনাথ যদি রোম্যান্টিসিজমে বুঁদ হয়ে যেতে পারেন, তা হলে বাঙালি কবিরা কখন কী লিখবেন, তা নিয়ে চিন্তিত হওয়ার দরকারই নেই।