সন্তোষ গুপ্ত : শিল্প-সংস্কৃতির বাতিঘর

সন্তোষ গুপ্ত কালের সাক্ষী, বয়সী বটের ছায়ার মতো যিনি নির্বিকারে বিচরণ করছিলেন আমাদের সাহিত্য, রাজনীতি ও সাংবাদিকতার বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায়। কে. এম. দাস লেনের সড়ক ধরে নিভৃতে হেঁটে চলা সে মানুষটিকে কেউ আর দেখবেন না কোনো দিন। তিনি চলে গেছেন অনন্তের ঠিকানায়, যেখান থেকে কেউ আর ফেরে না। খুব প্রিয় সিগারেট তিনি যখন পান করতেন, তার প্রতিটি টানই সুখটান হয়ে ঢুকত ভেতরে। কতটা যত্নে এই মৃত্যুপান, দেখলে অবাক হতে হতো! কখনো কখনো কেশে উঠতেন, তবুও তার ধূমপান বন্ধ করে কে? এ নিয়ে প্রশ্ন তুললে বলতেন, ‘সিগারেট খেলে কিছু হয় না। আর জীবনটা তো ধোঁয়াই, ধোঁয়া করেই উড়িয়ে দিই।’
অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন সন্তোষ গুপ্ত। চিত্রকলা থেকে নাট্যকলা, দর্শন থেকে রাজনীতি, লোককথা—সবই ছিল তাঁর নখদর্পণে। খুব কম কথা বলতেন, যা বলতেন তা-ও ধীর লয়ে। উত্তর দিতেন সোজাসাপ্টা। কেউ একে রূঢ় ভাবলেও তাঁর কিছু আসত-যেত না। এককথায় বলা যায়, উচিত বক্তা ছিলেন তিনি। সততা, নিষ্ঠা ও আত্মবিশ্বাস ছাড়া যেটা মোটেও সম্ভব নয়। বিশ্বাস ও বক্তব্যের মধ্যে তাঁর ফারাক ছিল না। ১৯৯৪ সালে ‘দৈনিক রূপালী’র একটি বিশেষ সংখ্যার লেখা আনতে গিয়ে চিনেছিলাম সন্তোষ গুপ্তকে। তার পর ‘আজকের কাগজ’-এর পুরোটা সময়। অনেক বিকেল কিংবা রাতের অনেকটা সময় তাঁর বাসায় কাটিয়েছি। তাঁর সাহচর্যে থাকতে পেরেছি অনেক দিন। এর মধ্যে শুধু একদিন তাঁকে রাগ করতে দেখেছি। তাঁর রাগ সাধারণত বোঝা যেত না। কিন্তু ওই দিনের ঘটনা ছিল ভিন্ন।
প্রিয়তোষ গুপ্তের ছোট ছেলে—ডাকনাম সেন্টু, আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমাদের আরেক বন্ধুর নাম হিমেল মিত্র। হিমেলের বিয়ে নিয়ে আমরা ব্যস্ত, যে কারণে বেশি রাত করে ফেলেছিলাম। আমাদের খাবার কথা ছিল সন্তোষ গুপ্তের বাসায়। রাত ১২টার পর আমরা ভয়ে ভয়ে ফিরলাম। দেখলাম ঘুমাননি। বাসার সামনে দাঁড়িয়ে কী এক অজানা শঙ্কায় পায়চারি করছেন আর সিগারেট ফুঁকছেন। আমরা কোনো কথা বললাম না। ঘরে ঢুকে হাত-পা না ধুয়েই খেতে বসলাম।
সন্তোষ গুপ্ত ঘরে ঢুকলেন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে। অদৃশ্যের উদ্দেশে বললেন, ‘বিয়ে করে পরে, না ইচ্ছে মরে নরে।’ আসলে গোপীবাগ খুব সন্ত্রাসকবলিত বলেই দেরি করে ফিরলে তিনি দুশ্চিন্তা করতেন। তাঁর কাছে জীবনের বহু মজার ঘটনা শুনেছি। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে, শহীদুল্লা কায়সারের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব নিয়ে। আমৃত্যু তিনি শহীদুল্লা কায়সারকে খুব মনে করতেন। খুব অন্তর্মুখী স্বভাবের মানুষ বলে তাঁর প্রকাশটা ছিল একটু ভিন্ন। তিনি বলতেন যে, শহীদুল্লা কায়সারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটা ছিল অন্যদের চেয়ে আলাদা। কখনো হয়তো ঝগড়া হয়ে কথা বন্ধ হয়ে যেত, কিন্তু একটা সিগারেটের অর্ধেক খেয়ে তিনি অন্যদিকে ফিরে বাকি অর্ধেকটা তাঁর দিকে বাড়িয়ে দিতেন। হয়তো একই জন্মদিনের অনুষ্ঠানে দুজন যাবেন, কিন্তু একজন তো অন্যজনের সঙ্গে কথা বলেন না। তাতে কী? একজন নিচে নামার আগে পাশের একজনকে জানিয়ে দিয়ে নিচে নেমে রিকশা ঠিক করে অন্যজনের আশায় বসে থাকতেন। রিকশা চলাকালীন অবস্থায়ও সিগারেট বিনিময় ওভাবেই হতো।
কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি কত নিষ্ঠা ও আনুগত্য থাকলে একজন সরকারি কর্মকর্তা নিশ্চিত বিপদের দিকে পা বাড়ান, তার প্রমাণ সন্তোষ গুপ্ত। আজীবন বিশ্বাসে অবিচল এ মানুষটি সুবিধার পিছু নেননি। শিরদাঁড়া সোজা করে যে কারো কথার প্রতিবাদ করার অভিনব কৌশল কোথা থেকে অর্জন করেছিলেন, জানি না। আজীবন তিনি তাঁর লক্ষ্যে, আচারে-অনুষ্ঠানে, চলনে-বলনে একটুও বদলাননি। ধূমপানে নিষেধ ছিল বহু আগে থেকেই। তবুও বাইরে যাওয়ার কথা বলে ধূমপান করতেন। কখনো চোখে পড়লে বলতেন, ‘মণিকে (তাঁর একমাত্র আদুরে কন্যা, থিয়েটার কর্মী ও জার্মানপ্রবাসী অদিতি গুপ্তা) বলা যাবে না। বললাম তো, এটাই শেষ।’
আমি মাঝেমধ্যে হাসতে হাসতে বলতাম, ‘যদি বলি?’
বলতেন, ‘বাসায় ঢুকতে দিমু না।’
তাঁর সঙ্গে সবার আলাপ জমত না; কিন্তু যাঁর সঙ্গে জমত, তিনি পরিচিত হতেন এক বাঙালি পণ্ডিতের সঙ্গে। সন্তোষ গুপ্ত কারো কারো দৃষ্টিতে আওয়ামীপন্থী ছিলেন। কিন্তু তাঁর লেখায় কাউকে সন্তুষ্ট করার প্রবণতা ছিল না। ফলে তিনি যা বুঝতেন, যা বিশ্বাস করতেন তা-ই লিখতেন। ১৯৬৬ সালে আমি দেশ ঘুরে বেড়ানোর একপর্যায়ে মেঘালয় সীমান্তে চলে গেলাম। ওখান থেকে সুসং দুর্গাপুর হয়ে এসে একটা নিয়মিত কলাম লিখতে শুরু করি সংবাদ-এ। নাম ছিল ‘সুসং-দুর্গাপুর : পথে পথে’। এর ইতিহাসগত বিষয় নিয়ে বিতর্ক জুড়ে দেন এক আইনজীবী। সন্তোষ গুপ্ত তাঁর লেখাও ছাপতেন, সঙ্গে নিজে তাঁর জবাবটাও লিখে দিতেন। এই ইতিহাস বিতর্ক চলেছিল মাসব্যাপী। ইতিহাসে তাঁর পাণ্ডিত্য কতটা ছিল, ওই লেখা যাঁরা পড়েছেন তাঁরা অনুমান করতে পারবেন। সাংবাদিক হিসেবে তাঁর দায়বদ্ধতা স্বীকার করার কারণেই শত বাধা সত্ত্বেও, পরিবারের শত অনুরোধ উপেক্ষা করে সব সময় সন্তোষ গুপ্ত চলেছেন দুর্বার। একটু বাঁকা হয়ে হাতে ছোট ব্যাগটা নিয়ে সিগারেট দুই আঙুলের ফাঁকে রেখে মুঠ করে পথ চলতেন সন্তোষ গুপ্ত। ধীর লয়ে চলা ছিল তাঁর স্বভাবসিদ্ধ; কিন্তু এ মানুষটিকে পেছনে ফেরানোর সাধ্য ছিল না কারো। পোড়খাওয়া মানুষ ছিলেন তিনি। এ জন্য হয়তো তাঁর অন্তর্গত কষ্টও ছিল, কিন্তু প্রকাশ করতেন না কিছুই।
২
লেখালেখিতে তাঁর খ্যাতি আসে শুধু কবিতায়, প্রথম দিকে। আধুনিক কবিদের কাব্য বিচারে তাঁর কবিতা অনন্য। কিন্তু পরে প্রবন্ধ সাহিত্যে মনোনিবেশ করেন। সন্তোষ গুপ্তের বই ‘ইতিহাস আমাদের দিকে’, ‘সমাজতন্ত্রের অন্য ইতিহাস’, ‘স্মৃতি-বিস্মৃতির অতলে’ এবং চিত্রকলার সমালোচনাসহ বহুমাত্রিক সাহিত্যচর্চা করেছেন তিনি। আপাত অর্থে ১৯৬২ সালে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে সরে দাঁড়ানো এবং সমাজতান্ত্রিক চিন্তা সম্পর্কে তাঁর মতামত অনেকটা বদলে গেলেও অকপটে তিনি তা বলে গেছেন। তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে আমাদের দ্বিমত থাকবে, এটাই তো বাস্তব। কিন্তু মতপ্রকাশে তিনি কুণ্ঠা করতেন না, যে কারণে একজন জেলখাটা তুখোড় কমিউনিস্টের লেখায় আমরা দেখি ভিন্ন সুর। সন্তোষ গুপ্তের বক্তব্য স্পষ্ট। তিনি লিখেছেন :
‘অন্যান্য দর্শনের সঙ্গে মার্কসীয় দর্শনের মৌলিক পার্থক্য হলো মার্কস রাজনীতিকে তাঁর দর্শনের অপরিহার্য অংশ করেছেন। লেনিন তাঁর অনুসরণে দৃঢ় সংগঠন ও কঠিন নিয়মানুবর্তিতা প্রয়োগ করে বলশেভিক পার্টি গড়ে তোলেন। রাশিয়ায় অক্টোবর বিপ্লবে নেতৃত্ব দেয় বলশেভিক পার্টি, যা পরবর্তী সময়ে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে পরিচিত। সমাজ পরিবর্তনের জন্য সর্বহারা একনায়কত্বের ধারণা প্রচলিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতির বিপরীত। প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে কমিউনিজমের পার্থক্য হলো প্রথমটি ভাববাদী ও দ্বিতীয়টি পরলোক নিরীশ্বরবাদী ইহজাগতিক ধর্ম। একেশ্বরবাদের স্থান নিয়েছে মনোলিথিক পার্টি-কাঠামো। গণতন্ত্রের চর্চার অস্বীকৃতির কারণেই মানুষ মুক্তির এই মহৎ আদর্শ ট্র্যাজেডি হয়ে দেখা দিল যুগান্তরের পথ নির্মাণের সাধনার ক্ষেত্রে।’
তাঁর মতে, যেসব দেশে কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতা দখল করেছে, তারা সবাই একটি মডেলই ব্যবহার করেছে। পরম অসহিষ্ণুতা একনায়কত্বের অঙ্গ। আর একনায়কত্ব মানেই স্বেচ্ছাচার। ইতিহাসের এই শিক্ষা ও অভিজ্ঞতাকে অস্বীকার করে মানবমুক্তির মডেল হিসেবে গৃহীত পথটির চরিত্র দেখা গেল কমিউনিস্টশাসিত সব দেশেই একরকম। এটা যখন প্রমাণিত হলো, তা নিয়ে আমাদের দেশের কোনো কমিউনিস্ট গ্রুপ প্রশ্ন করেনি। আদর্শগত মতান্ধতা, ধর্মীয় মতান্ধতা কিংবা জাতি শ্রেষ্ঠত্বের নামে উগ্র জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সামরিক শক্তি যুক্ত হলে তারা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ফ্যাসিবাদের জন্ম দেয়। বিশ্বাস তার অঙ্গ, যুক্তি নয়। এই যুক্তিহীন পদ্ধতি প্রলেতারীয় একনায়কত্বের নামে জাতীয় গণ্ডি অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক রূপ ধারণ করলেই তার চরিত্র বদলায় না।
সন্তোষ গুপ্ত আরো বলেছেন ক্রুশ্চেভের সংশোধনবাদ ও স্টালিনের শ্রমশিবিরের কথা। তিনি বহু লেখক-শিল্পী নির্যাতনের সূত্র ধরে ও অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সংকট নিয়ে সমাজতান্ত্রিক সমাজের অন্য ইতিহাস লিখেছেন। আবার তাঁরই গ্রন্থ স্মৃতি-বিস্মৃতির অতলে আমরা দেখি বাংলাদেশের রাজনীতিরও কট্টর সমালোচনা। এত কিছুর পরও জীবনযাপনে সন্তোষ গুপ্ত যেমন ছিলেন সাধারণ, তেমনি ছিলেন বিরলপ্রজ এক ব্যক্তি, যাঁর সততা ও নিষ্ঠার কাছে সব হেরে যায়। তাঁর ‘অনিরুদ্ধ’ কলামের সঙ্গেও অনেকের দ্বিমত আছে; কিন্তু তাঁর যুক্তিকে ফেলে দেওয়ার পথ নেই। সন্তোষ গুপ্তের লেখায় যুক্তিবাদ যেমন প্রখর ছিল, তেমনি তথ্যের ছিল ব্যাপকতা। তাঁর লেখ্যশৈলীর গতিশীলতা পাঠককে বিমোহিত করত। যে কারণে স্যাটেলাইটের যুগেও ‘অনিরুদ্ধ’কে কেউ ভোলেনি, ভুলবে না।
৩
সন্তোষ গুপ্ত সাধারণত লিখতে রাজি হতেন না। শেষ দিকে একদম না। মাঝে প্রায় অবসর নিলেন সংবাদ থেকে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে অনেক পরিবর্তন ঘটে গেল। আমি মিরপুরে চলে এলাম। যোগাযোগে ভাটা পড়ল। বন্ধু সেন্টুর সঙ্গেও যোগাযোগের ঘাটতি চরম আকার নিল। খবর পেতাম। দেখা হতো না। এরই মধ্যে চট্টগ্রাম যেতে হলো পত্রিকার কাজে। তার পর আর কী? কে. এম. দাস লেন এখন সন্তোষ গুপ্তশূন্য। ফুটপাত ধরে সিগারেট মুঠোতে ধরে সুখটান দিতে দিতে চলা স্বল্পভাষী মানুষটি আর কোনোদিন হাঁটবেন না ওই পথে। নীরবে নিঃশব্দে তিনি চলে গেলেন।
এই বিশাল সময় অদেখার দায় কী দিয়ে পূরণ করা যায়? ব্যক্তিগত জীবনে সৎ, অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল ও বাম মতাদর্শের প্রতি অবিচল আস্থাশীল এই বাঙালি মনীষীর চলে যাওয়ায় যে অপূরণীয় ক্ষতি হলো, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মৌলবাদের বিরুদ্ধে সর্বদা সোচ্চার নির্ভীক এই বহুমাত্রিক কলমযোদ্ধা দীর্ঘ সময় তাঁর ক্ষুরধার লেখনী দিয়ে দেশ ও মানুষের মুক্তির জন্য লড়াই করে গেছেন। মাটি ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান ছিলেন। জীবনে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও রাজন্যকুলের ছত্রছায়া ও কোনো প্রকার সুবিধা গ্রহণের বিরোধী ছিলেন তিনি। আজ তাঁর জন্মদিনে জানাই শ্রদ্ধাঞ্জলি।